ভূমিকা: ইসলামে আকিদা (عقيدة) হলো মুসলমানদের বিশ্বাস ও ধারণার মূল ভিত্তি। এটি ইসলামের একটি অপরিহার্য অংশ, যা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নবী-রাসূলদের প্রতি সম্মান, আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, এবং সমস্ত ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে। আকিদা হলো সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান, যা একজন মুসলিমের বিশ্বাসকে গঠন করে এবং তার জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে। ইসলামের মৌলিক আকিদাগুলো মুসলিমদের জীবনে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সঠিক দিশা প্রদান করে।
আকিদার সংজ্ঞা: আকিদা শব্দটি আরবি “عقد” (আকদ) থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো “বন্ধন” বা “দৃঢ় বিশ্বাস”। ইসলামী পরিভাষায়, আকিদা হলো সেসব মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাস যা একজন মুসলিমের অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যা তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। আকিদা শুধুমাত্র বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং তা মানুষের চিন্তাধারা, আচরণ ও জীবনের মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায়।
ইসলামে আকিদার মৌলিক উপাদান: ইসলামের আকিদা মূলত কয়েকটি প্রধান মৌলিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এগুলোর মধ্যে অন্যতম:
১. আল্লাহর একত্ব (তাওহীদ): ইসলামের প্রথম ও প্রধান আকিদা হলো আল্লাহর একত্ব (তাওহীদ)। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ একমাত্র উপাস্য, তাঁর কোনো শরিক বা অংশীদার নেই।
আল্লাহ স্বয়ং সম্পূর্ণ, চিরকালীন এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব সর্বত্র।
কুরআনে আল্লাহ বলেন— “আল্লাহ নিজেই একমাত্র উপাস্য, অন্য কোনো উপাস্য নেই।” (সূরা আল-ইখলাস: ১-৪)
২. নবুওয়াত (রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস): ইসলামে ঈমান আনার জন্য নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ বিশ্ব মানবতার হেদায়েতের জন্য রাসূল পাঠিয়েছেন।
সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী হলেন মুহাম্মাদ (সা.), যিনি আল্লাহর শেষ ধর্মগ্রন্থ কুরআন প্রাপ্তির মাধ্যমে মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন।
কুরআনে বলা হয়েছে— “মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর সহচররা মুমিনদের জন্য একে অপরকে সাহায্যকারী।” (সূরা আল-ফতহ: ২৯)
৩. আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস: একজন মুসলিম বিশ্বাস করে যে, দুনিয়ার পর একটি জীবন রয়েছে, যাকে আখিরাত বলা হয়। সেখানে মানুষের আমলের হিসাব হবে এবং সে অনুযায়ী তাকে পুরস্কৃত বা শাস্তি দেওয়া হবে।
কিয়ামত দিবসে সবাই পুনরুত্থিত হবে, সৎকর্মীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং পাপীরা জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে।
কুরআনে আল্লাহ বলেন— “আর যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।” (সূরা আল-বাকারাহ: ৮۲)
৪. ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস: ইসলামে ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস একটি অপরিহার্য আকিদা। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশ পালনকারী নিঃসন্তান সত্ত্বা, যারা মানবজাতির জন্য আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন।
তাদের মধ্যে কয়েকজন প্রধান ফেরেশতা হলেন: জিব্রাইল (আ.), মিকাইল (আ.), ইস্রাফিল (আ.), আজরাইল (আ.)।
কুরআনে বলা হয়েছে— “ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশে জীবন ধারণ করে, তারা কখনো আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না।” (সূরা তেহরীম: ৬)
৫. আল্লাহর কিতাবের প্রতি বিশ্বাস: ইসলামের আকিদার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ তাঁর নবীদের মাধ্যমে পৃথিবীতে কিছু পবিত্র গ্রন্থ পাঠিয়েছেন, যা মানবজাতির জন্য হেদায়েত।
সর্বশেষ গ্রন্থ হলো কুরআন, যা চিরকালীন এবং অক্ষুন্ন থাকবে।
অন্য কিতাবগুলো—তাওরাত (মুসা আ.), যবূর (দাউদ আ.), এবং ইঞ্জিল (ইসা আ.)—সর্বোচ্চ মূল্যবান, তবে কুরআনই চূড়ান্ত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ।
৬. তাকদির বা পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস: মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে সব কিছু আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত এবং সৃষ্টির সত্তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে।
তাকদিরের মধ্যে ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা সবকিছু অন্তর্ভুক্ত। তবে মানুষের উপর কিছু দায়িত্বও রয়েছে—তার চেষ্টা এবং প্রার্থনা।
কুরআনে আল্লাহ বলেন— “তুমি যা কিছু পাবে, তা একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায়ই পাবে।” (সূরা আল-ইনশিরাহ: ৫)
আকিদার প্রভাব ও গুরুত্ব:
১. ঈমানের ভিত্তি স্থাপন: আকিদা ইসলামের ঈমানের ভিত্তি স্থাপন করে, যা মুসলমানের প্রতিদিনের জীবন, আচার-আচরণ, চিন্তাধারা, এবং আধ্যাত্মিক গুণাবলীর উপর প্রভাব ফেলে।
২. এককেন্দ্রীক বিশ্বাসের প্রতি দৃষ্টি: আকিদা মুসলমানদের আল্লাহর প্রতি এককেন্দ্রীক বিশ্বাস এবং সমস্ত দুনিয়ার বিষয়গুলোকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে রাখার শিক্ষা দেয়।
৩. আখিরাতের প্রস্তুতি: আকিদা মুসলমানদের আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলে, যা তাদের সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে সফলতা অর্জনে সাহায্য করে।
৪. শান্তি ও স্থিতিশীলতা: যেহেতু আকিদা আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা এবং তার প্রদত্ত সঠিক পথ অনুসরণ করার শিক্ষা দেয়, এটি মুসলমানদের জীবনে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আত্মবিশ্বাসের সূচনা করে।
উপসংহার: আকিদা হলো ইসলামের মৌলিক ভিত্তি, যা মুসলমানদের বিশ্বাসের কাঠামো গঠন করে। একজন মুসলিমের জন্য সঠিক আকিদা ও বিশ্বাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তার আধ্যাত্মিক, সামাজিক, এবং নৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। ইসলামি আকিদা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে, তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং আখিরাতে সফলতা লাভে সহায়ক হয়।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক আকিদার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: জুনাইদ বিন মুহিব
Leave a Reply