আমাদের বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত প্রাবন্ধিক বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। দ্বিতীয়া হলেন নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও বাংলার জননী কবি সুফিয়া কামাল।
অতঃপর স্বাধীনতা পরবর্তী মুসলিম নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে সর্বাগ্রে যার নাম বলবো তিনি হলেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব,মহীয়সী নারী ও অপরাজেয় কথা শিল্পী সেলিনা হোসেন।….
তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে যত পড়ছি ততই অবাক হচ্ছি!!কতো সাবলীল ভাষায় সব ধরণের দুর্বোধ্যতা এড়িয়ে চমৎকার ভাবাবেগ নিয়ে তিনি তাঁর মনের কথা লিখেছেন, দেশের কথা লিখেছেন, এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বীরাঙ্গনাদের কথা, যুদ্ধের কথা তৎকালীন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কথা, তৃণমূলের সাধারণ মানুষের কথা লিখেছেন!!
তাঁর এই সাহিত্যকর্ম এই লেখনীর জন্য তিনি তাঁর জীবনকালে এতো পুরস্কার অর্জন করেছেন যে সত্যিই সেটা আনন্দের চির গৌরবের!!এতো এতো পুরস্কার অর্জন করেছেন এতো এতো উপাধি তিনি পেয়েছেন যে তা জেনে তাঁর জীবনী পড়ে আমি আবেগাপ্লুত আমি বিমোহিত!!
বাংলা সাহিত্যে কোন নারী সাহিত্যিক আজ অবদি এতো সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন কি না আমার সত্যি জানা নেই!!
এই মহীয়সী নারী সাহিত্যিকের এক জনমের সমস্ত অর্জন নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ-
তিনি রাজশাহীতে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিভাগীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়নশিপ স্বর্ণপদক পান।ড.মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক(১৯৬৯),বাংলা একাডেমী সাহিত্য(১৯৮০),আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১),অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪),শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬ ও ১৯৯৭),দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য “রামকৃষ্ণ জয়দয়াল হারমোনি অ্যাওয়ার্ড “দিল্লি (২০০৬),জাতীয় পুরস্কার একুশে পদক (২০০৯),দিল্লীর ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানিং এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে “রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার “(২০১০),লেডিস ক্লাব কর্তৃক লায়লা সামাদ স্বর্ণপদক (২০১১),রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা থেকে ডিলিট উপাধি (Honoris Causa)২০১০,
“গায়ত্রী সন্ধ্যা” উপন্যাসের জন্য আইআইপিএম,দিল্লি কর্তৃক রবীন্দ্র পুরস্কার ২০১০।দিল্লির সাহিত্য আকাডেমী থেকে প্রেমচাঁদ ফেলোশিপ লাভ ২০০৯।
‘ নীল ময়ূরের যৌবন ‘ও ‘ যাপিত জীবন ‘ উপন্যাস রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ‘ নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি ‘ ও ‘ হাঙ্গর নদী গ্রেনেড ‘ উপন্যাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য।প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতায় গল্প পাঠ্য।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ , ‘নীল ময়ূরের যৌবন ‘ও ‘ হাঙ্গর নদী গ্রেনেড ‘ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য।এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ৩ টি উপন্যাস নিয়ে এমফিল থিসিস সম্পন্ন করা হয়।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে ২০০৬ সালের দুই সেমিস্টারের পাঠ্য ছিল ‘ হাঙ্গর নদী গ্রেনেড ‘ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিস ডিপার্টমেন্টে ‘ কালকেতু ও ফুল্লরা ‘ উপন্যাস পাঠ্য।
এছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি, কন্নর,রুশ,মালে,ফরাসি, জাপানি,উর্দু, মালয়েলাম,কোরিয়ান, ফিনিস,আরবি প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প এবং উপন্যাস।….
ভাবা যায় একজন নারীর পক্ষে এই সফলতা এই অর্জন কতোটা আনন্দের আর কতোটা চির সুখের আত্ম অহংকারের।…. একজন মুসলিম নারী হয়ে জীবনে চলার পথে শত বাধা বিঘ্নতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে গিয়েই তিনি আজ সেলিনা হোসেন হয়েছেন।
ভাবতে অবাক লাগে কোথায় তিনি আর কোথায় আমরা।…এদেশে মেয়েরা বি.এ, এম.এ পাশ করেও একবিংশ শতাব্দীতে ঘরে বন্দী থাকে গৃহিণী হয়ে।তাদের সীমানা বড় জোড় শ্বশুর বাড়ি, শ্বশুরকুল আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি,সন্তানের স্কুল কলেজ কোচিং সেন্টার,বড় বড় শপিং মল,কাঁচাবাজার… শত শত মেধাবী মেয়েরা ভালো ভালো রেজাল্ট করেও , রুপবতী গুণবতী হয়েও স্বামী শ্বশুর বাড়ির লোকজনের লাঞ্ছনায় গঞ্জনায় শিক্ষাগত যোগ্যতার সমস্ত সার্টিফিকেট আলমারিতে ভাজ করে গুছিয়ে রেখে দিয়ে আদর্শ গৃহিণী সাজে আদর্শ ভাবি সাজে!! আর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে… ‘ আল্লা ভাবি জানেন না তো আমার মেয়েটা এই… আমার ছেলেটা সেই… আল্লা ভাবি শুনছেন পাশের বাসায় কি হয়েছে, ঐ পাড়ার ঐ মেয়ে টা ঐ ছেলেটার কি হয়েছে???….আরে জানেন না তো ভাবি আমার হাজবেন্ড তো আমাকে জব করতে দেয় না।ও তো মেয়েদের জব করাটা একদমই পছন্দ করেন না।আরে শুনেন না ভাবি আমার হাজবেন্ড তো পর্দানশীন ফরহেজগার মেয়ে অনেক পছন্দ করেন।কি বলেন ভাবি আপনার ভাইকে তো আমার আইডির পাসওয়ার্ড ও দিতে হয়।….ভাবি শুনছেন আমার ওতো আমার নতুন নতুন রেসেপির রান্না খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।…..
আমার খুব রাগ লাগে একটা মেয়ে এতো শিক্ষিত হয়েও কেন আত্মনির্ভরশীল হবে না কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদাবান হবে না। তা না হলে শুধু শুধু বাবা মায়ের কষ্টের অর্জিত অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় না করে মেয়েদেরকে অল্প বয়সে অল্পশিক্ষিতা করে বিয়ে দেওয়াই শ্রেয়।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিশ্বের আলোকিত নারীরা এখন কোথায় না পদার্পণ করছে!আজকে তাঁরা কোথায় না অবদান রাখছে! আমাদের প্রিয়ভাষী শ্রদ্ধেয়া সেলিনা হোসেন আমাদের ব্যক্তিমাসনসের শিল্পীসত্তার প্রেরণাদায়িনী একজন নারী। আমার তো মনে হয় এ জীবনে এ ধরনের একটা পুরস্কার পেলেও আমার সার্থক মৃত্য হবে সার্থক জন্ম হবে।নইলে এ যাপিত জীবনের কি মানে আছে…!!!
——————–
শামীমা আক্তার
কবি, লেখক ও প্রভাষক
Leave a Reply