নিজস্ব প্রতিবেদক
রফিকুল ও মীম দম্পতির দু’জনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হয়েও প্রতিবন্ধকতার কাছে হার মানেননি তারা। দুই জনই উচ্চ শিক্ষিত। একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেন অনার্স-মাস্টার্স। একে অপরকে ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছেন। বর্তমানে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছোট একটি সংসার তাদের। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও নেই তাদের কোন কর্মসংস্থান। সংসার জীবনের শুরু থেকে আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় কোনমতে খেয়েপুড়ে থাকলেও মহামারি করোনার প্রাদূর্ভাব কালিন সময়ে দূবির্ষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। কারণ যে সকল স্বজনরা এতোদিন তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করে এসেছে তাদেরই এখন চলতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। বর্তমানে এ দম্পতি মানবতের দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে।
এ দম্পতি জানায়, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি জন্য সরকারি- বেসকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরির জন্য লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। অনেক ব্যাংকেও করেছেন আবেদন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। কোন দপ্তরেই মিলেনি তাদের চাকরি। আলোহীন চোখ নিয়ে দুজনেই দেশের খ্যাতনামা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরুলেও চাকরি না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় অন্ধকার নেমে আসে তাদের সংসার জীবনে। অনেক গুলো চাকরির লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিলেও বাদ পড়েছে মৌখিক পরীক্ষায় গিয়ে। নিজে কিছু করার চেষ্টায় তবুও থেমে থাকেনি তারা। শিক্ষা জীবন শেষ করার পর থেকেই চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে আজ তারা ক্লান্ত। এ দম্পতির আবেদন শুধু মাত্র একটি চাকরি চাই। যা দিয়ে অন্ধকার ভূবনে তিন বেলা খেয়ে পড়ে তাদের ছেলে-মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে পারেন।
রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের ফুলদী গ্রামের নোয়াব আলী মোল্লার পাঁচ সন্তানে মধ্যে রফিকুল তৃতীয়। তিন বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে দৃষ্টি হারান রফিকুল । তবে হার মানেনি রফিকুল । গাজীপুরের নীলের পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি, ২০০৭ সালে শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। পরে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স পাসসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
শাহিদা আফরোজ মীম এর জন্ম চাঁদপুরের হাইমচরে। তারা পাঁচ বোন ও এক ভাই। নদী ভাঙ্গনে তাদের সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। পরে তার পিতা আব্দুল আজিজ সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। এ সুবাধে শৈশব কাটে তার ঢাকার মিরপুরে। মীমের বয়সও যখন তিন বছর বয়সে হামে দৃষ্টি হারায় সে। তার বয়স যখন ১১ বছর তখন সে তার পিতাকেও হারায়। ফলে শৈশব কাটে তার অনেক কষ্টের মধ্যে। তার পরও থেমে থাকেনি সে। মীম মিরপুরের আইডিয়াল স্কুল এন্ড গার্লস কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এসএসসি, ২০০৫ সালে বেগম বদরুন্নেসা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ থেকে অনার্স ও ২০১১ মাস্টার্স করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা কালে এক সিনিয়র ভাইয়ের স্ত্রীর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শাহিদা আফরোজ মীম এর সাথে যোগাযোগ হয় রফিকুলের। এরপর পরিচয়, এ পরিচয় থেকে প্রেম-ভালোবাসা। কিন্তু একে অপর কে না দেখতে পারলেও মনের ভালোবাসার টানে ২০১১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় মীম-রফিকুল। এর মধ্যেই ২০১৪ সালে তাদের ঘর আলো করে আসে পুত্র শামিউল ইসলাম সিয়াম। তার বয়স এখন ৬ বছর। পড়ছেন নরসিংদী জেলা শহরের সানবীম স্কুলের প্লে গ্রুপে। ২০১৯ সালে জন্ম নেয় তাদের দ্বিতীয় সন্তান জান্নাতুল ফাতেমা। বর্তমানে এই দম্পতি নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের দাসপাড়ার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। তাদের সংসার চলছে দু’জনেরই আত্মীয়-স্বজনদের আর্থিক সহয়তায়। কিন্তু এভাবে কি জীবন চলে।
তারা চায় অন্ধকার ভুবনে সরকারী-বেসরকারী যে কোন একটি চাকরির ব্যবস্থার। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় বাবার সহযোগিতায় চলতাম। ২০১৫ সালে বাবা মারা যায়। এর পর থেকে আমার অন্ধকার জীবনে আরও অন্ধাকার নেমে আসে। বর্তমানে ক্লান্ত শরীর ও দৃষ্টিহীন চোখ তাদের নিয়ে ভাবনা থামিয়ে দিলেও জাগিয়ে তুলে দুই সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তায়। সুস্থ্ স্বাভাবিক ৬ বছর বয়সী সন্তান সিয়াম ও এক বছর বয়সের ফাতেমাকে তিন বেলা খাবার দেয়ার বিষয়েও ভাবতে হচ্ছে তাদের। কিভাবে তাদের লেখাপড়া করাবে, কিভাবে তাদের বড় করে তুলবে, এসব চিন্তা প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। এখন যদি তাদের একটি চাকরি ব্যবস্থা হয় তাহলে দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে হয়ত এ সন্তানদের মানুষ করতে পারতেন। তা না হলে অন্ধকার ভুবনে অন্ধকারই থেকে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, ‘এখন পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে, আর পারছি না। যদি কোন হৃদয়বান ব্যক্তি আমাদের সহযোগিতা করেন বা একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেদিতেন, যা দিয়ে জীবন চলার পথ হবে আমাদের।”
শাহিদা আফরোজ মীম বলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেও চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রনায় আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। ২০১১ সাল থেকে আমরা দুজন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে থাকি। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরির জন্য পরীক্ষাও দিয়েছি। কিন্তু কোথাও চাকরি হচ্ছে না। কোথাও লিখিত পরীক্ষায় পাস করলেও মৌখিক পরীক্ষায় টিকতে পারিনি। এখন আমাদের জীবনটা খুব কষ্টে কাটছে। মাসে সংসার চালাতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। আমাদের কোন আয়-রোজগার নেই। সংসারে আমরা দু’জনের সাথে রয়েছে আমাদের দু’টি সন্তান। এ মূহুর্তে আমাদের জন্য একটি কর্মসংস্থানের খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন কোন হৃদয়বান ব্যক্তি যদি থাকতো যিনি আমাদেরকে একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে সাহায্য করতো। তাহলে হলে আমাদের সংসারটা চলে যেত। অন্য পাঁচজনের সন্তানদের মত আমাদের দুই সন্তান ভবিষ্যৎ ভাবনা আর করতে হতোনা। এখনতো দুই সন্তান নিয়ে মরা ছাড়া আর কোন পথ দেখছিনা। এছাড়া কি আর করার আছে আমাদের? খাবার না পেলে মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে?”
রফিকুল ইসলামের মা বৃদ্ধা জোবেদা খাতুন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘ছোট থেকে টাইফয়েড জ্বরে চোখের দৃষ্টি হারানো ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছি। পড়াশুনা করিয়েছি দেশে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশা ছিল একটি চাকরি পেলে নিজে চলতে পারবে। স্বামী হারা আমি এখন নি:শ্ব। যে বয়সে মানুষ পরকালের চিন্তা নিয়ে থাকে। আর আমি এ বয়সও দৃষ্টি হারা ছেলে ও তার দৃষ্টি হারা স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পরে আছি। এটাই কি আল্লাহ আমার ভাগ্যে লিখে ছিল। তাদের কি কোন একটা চাকরির ব্যবস্থা হবে না।’
নরসিংদী সুইড বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, ‘রফিকুল ইসলাম ও মীম এ দম্পতি তারা দুই জনই উচ্চ শিক্ষিত। আমার দেখা এ দম্পতিটি তাদের দুটি সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তাই অসহায় এ উচ্চ শিক্ষিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পরিবারটিকে বাঁচাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার উচিত বলে আমি মনে করি।’
জোনাকী টেলিভিশন/এসএইচআর/১৪ জুলাই ২০২০ইং
Leave a Reply