নিজস্ব প্রতিবেদক
নাম জোনাকী। পুরো নাম জাকিয়া আরেফিন জোনাকী। নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) একজন উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তার কাছে কেউ সেবা নিতে গেলে তার ভাবখানা দেখে মনে হবে হয় সে জেলার জেলা প্রশাসক, নয়তো জেলার কোন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা।কাউকেই পরোয়া করে সে। যে কোন সেবার ক্ষেত্রে কয়েকগুণ বেশী অতিরিক্ত ফি দিয়ে হয়রানীর যেন অন্ত নেই সেবা গ্রহিতাদের। দিনের পর দিন পরিষদের বারান্দা চক্কর কাটতে হয়। হয়রানির পাশাপাশি তার কাছ থেকে অপদস্তও কম হননা। দীর্ঘদিন ধরে চিনিশপুর ইউনিয়ন পরিষদে এরকম অবস্থা চলতে থাকলো দেখার যেন কেউ নেই।
ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে গত ২৮ নভেম্বর নরসিংদী জেলার ২২ টি ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে নরসিংদী সদর উপজেলার ১০ টি রায়পুরা উপজেলার ১২ টি ইউনিয়ন। বিগত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া ইউপি নির্বাচনে নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের ফলাফল ঘোষণার পর আলোচনা-সমালোচনার যেন অন্ত নেই। ওই নির্বাচনে নরসিংদী সদর উপজেলা সবক’টিতে নৌকার প্রার্থীরা জয় তুলে নিতে পারলেও একমাত্র চিনিশপুর ইউপিই আওয়ামী লীগের হাত ছাড়া হয়।
নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবিতে পুরো জেলাজুড়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। নৌকার ভরাডুবিতে মূল রহস্যে না গিয়ে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে। কেউ কেউ বলছেন নৌকার পরাজয়ের জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই দায়ী। আবার অনেকে বলেন উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়ার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নৌকার পরাজয় নিশ্চিত করা হয়। তবে সাধারণ ভোটার বলেন ভিন্ন কথা।
সাধারণ ভোটারদের মতে, চিনিশপুরে নৌকার নয়, পরাজয় হয়েছে জামান চেয়ারম্যানের। ইউনিয়নবাসীর মতে চিনিশপুরে নৌকা ডুবাতে এই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা জোনাকীই যথেষ্ট ছিল। নির্বাচনের ঠিক আগ মূহুর্তে সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের জমা দিতে হয়েছে ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন। আর এই জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করতে মানুষ ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ভীড় জমায়। প্রতিটি জন্ম নিবন্ধনের ফি বাবদ একশ’ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও চিনিশপুর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তা জোনাকী সর্বনিন্ম এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেও চিনিশপুর পরিষদের সেই সেবা গ্রহিতারা তাদের কাঙ্খিত সেবা পায়নি বলে অনেকের অভিযোগ।জন্ম নিবন্ধনের জন্য প্রায় প্রত্যেটি মানুষকে ঘুরতে হয়েছে মাসের পর মাস।
সেবা গ্রহিতারা জানায়, চিনিশপুর ইউনিয়ন পরিষদে আসা সেবা গ্রহিতারা কোন একটি সেবা নিতে এসে কয়েকগুণ অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়েছে পাশাপাশি হয়রানি শিকার হয়েছেন মাসের পর মাস। বর্তমানে তার কাছে গোটা ইউনিয়নবাসী জিম্মি। তার দ্বারা হয়রানির শিকারের বিষয়ে চেয়ারম্যান নূরুজ্জামানকে জানালেও তিনি বরাবর নির্বিকার থাকতেন। কোন একটি অদৃশ্য শক্তি কিংবা কোন একটি দায়বদ্ধতায় চেয়ারম্যান নিরব থাকার ব্যাপারেও ইউনিয়ন জুড়ে রয়েছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। জামান চেয়ারম্যানের নিরব থাকার বিষয়টি ইউনিয়নবাসী ভালো ভাবে নিতে পারেনি। বিগত ইউপি নির্বোচনে ভোটের মাধ্যমে এর জবাব দেন ইউনিয়নের সাধারণ সেই ভোটাররা।
মাহফুজুর রহমান নামে ঘোড়াদিয়া এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার ছেলে কাদির মোল্লার স্কুলে লেখা পড়া করছে। মাস ছয়েক আগে স্কুল থেকে ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন জমা দেওয়ার কথা জানানো হয়। পরে আমি চিনিশপুর পরিষদ থেকে জন্ম নিবন্ধন ফরম নিয়ে তা জমা দেই। এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে জন্ম নিবন্ধনটি দেওয়া বলা হলে এর জন্য আমি পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তা মেয়েটাকে ৫ হাজার টাকা দেই। এক সপ্তাহ দূরের কথা পুরা ছয় মাস ঘুরাঘুরি পর জন্ম নিবন্ধন গত কয়েকদিন আগে হাতে পেয়েছি। এর মধ্যে আমি বেশ কয়েকবার চেয়ারম্যান নূরুজ্জামানের স্মরণাপন্ন হলেও তার কাছ থেকে তেমন কোন রেসপন্স পাইনি।’
দৈনিক নরসিংদী নামে একটি অনলাইন নিউজ পোটালের বার্তা সম্পাদক চিনিশপুর ইউনিয়নের চিনিশপুর গ্রামের বাসিন্দা মাসুম ভূঁইয়া জানান, তার দুই সন্তানের জন্ম নিবন্ধন নিতে এসে একই গ্রামের বাসিন্দা এবং পরিচয় থাকা সত্যেও উদ্যোক্তা জোনাকীকে এর জন্য আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর তার জন্য তাকে ঘুরতে হয়েছে ৬ মাস।
শফিকুল ইসলাম নামে টাউয়াদী এলাকার এক ব্যক্তি জানান, তার সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে এসে ৩ হাজার টাকা দেন উদ্যোক্তা জোনাকীকে প্রায় সাড়ে ৪ মাস পরিষদের চত্বর চক্কর কাটার পর কাঙ্খিত সেই নিবন্ধন হাতে। সঠিক ও শুদ্ধ ভাবে নিবন্ধনের আবেদন ফরম পূরণ করে দিলেও তার হাতে পাওয়া নিবন্ধনটিতে ভুল তথ্য নজরে আসে। উদ্যোক্তার করা ভুলের জন্য তাকে আবারও দুই হাজার টাকা দিতে হয় তা সংশোধনের জন্য । এর জন্য তাকে প্রায় আরও সাড়ে ৩ মাস পরিষদে চক্কর কাটতে হয়।
ওই ব্যক্তি বলেন, ‘চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান সম্পর্কে আমার চাচা হন। নিবন্ধনের ভুল সংশোধনের জন্য উদ্যোক্তা আমার কাছে পূণরায় দুই হাজার টাকা দাবী করায় পরিষদে না থাকায় বিষয়টি জানাতে আমি চেয়ারম্যানের মোবাইলে ফোন দেই। আমার পরিচয় দিয়ে পুরো বিষয়টি ওনাকে জানানো পর ওনি উত্তরের বলেন, আসনে এটা তার (জোনাকীর) কাজ তাই কি করতে হবে না হবে এবং কি লাগবে না লাগবে এটা সেই ভাল বলতে পারবে। ওনার কথায় আমি একদম থমকে গেলাম। শুধু নিজের মনে মনে বললাম ‘চাচা সামনে ইলেকশান কথাটা ভুলে গেলেন মনে হয়।’ জবাবটা তখন দিয়ে দিব।’
হোসনেরা বেগম নামে বনবিভাগ এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘গত মাস ছয়েক আগে আমি আমার জন্মনিবন্ধনের জন্য এই মহিলাকে (উদ্যোক্তা জোনাকীর দিকে আঙ্গুল তুলে) ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এ পর্যন্ত যতদিন আইছি খালি কয় সার্ভার নষ্ট । আমার সার্ভার যে ৬ মাস ধইর্যা নষ্ট হইয়া পইর্যা আছে আর এর জন্য মানুষজন আইস্যা বারবার ফিরা যাইতাছে তা কি চেয়ারম্যান মেম্বাররা দেহে না।’
মো. সজিব মিয়া নামে উঠতি বয়সের এক যুবক জানায়, জন্ম নিবন্ধনের দুই মাস আগে আবেদন ফরম জমা দেয় আর এর জন্য তাকে গুণতে হয়ে এক হাজার টাকা। আজ দুই মাস যাবৎ তাকে বার ডেইট দিলেও তার জন্ম নিবন্ধন এখনও সে পায়নি। প্রতিবারই বলছে এখনও হয়নি। সার্ভারে সমস্যা।
বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে চিনিশপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে উপস্থিত হলে উদ্যোক্তা জোনাকীর সাথে দুই যুবককে তর্ক করতে দেখা যায়। সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে ওই যুবকদ্বয় অনেক কিছু বলতে গিয়েও আবার থমকে যায়। তাদের নাম পরিচয় জানাতে চাইলে সেটাও বলতে নারাজ তারা। শুধু ভাই কোন কারণে যদি জন্ম নিবন্ধনটা না পাই সেটা আমার লাইফের জন্য কতটা ক্ষতি হতে পারে তা কি ভাবতে পাচ্ছে?
ওদেরকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ানোর কিছু তারাও ভাই আমি আজ থেকে ৬ মাস আগে আমার জন্ম নিবন্ধন করতে আসি আর এর জন্য এই মহিলাকে পাঁচ হাজার টাকা দেই। এছাড়াও আজ পর্যন্ত যতদিন এসেছি ততদিন একশ টাকা করে তাকে দিয়েছি কিন্তু আজও আমার জন্ম নিবন্ধনটা হাতে পাইনি। কানাডার ভিসার জন্য আমার এপ্লাই করার কথা ছিল কিন্তু জন্ম নিবন্ধনের জন্য তা করা হয়নি। গত কয়েবদিন আগে আমি রাগে ক্ষোভে এই মহিলাকে ইট দিয়ে ভারিও দিতে গিয়েছিলাম।
নরসিংদী ইউডিসি ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রায়হান সরকারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এরকম অভিযোগ পেলে আমরা সমিতি সুবিদা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। চাকুরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিদা থেকে তাকে বাদ দেওয়ার জন্য সুপারিশ পাঠাই মাত্র।
এব্যাপারে চিনিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শাহ আলম বলেন, এই উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে নালিশ শুনতে শুনতে আমি বাধ্য হয়েছিতারন কাছ থেকে আমার অইডি নিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি।িএখন আর তাকে জন্ম নিবন্ধন করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি আমার আই নেওয়ার পর নিবন্ধনের ফি বাবদ ৫০ হাজার টাকা পরিষদ তার কাছে পাওনা হয়। এখনও পর্যন্ত সেই টাকা সে না দেওয়ায় বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবগত করেছি।
এব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ( উপসচিব) ভূঁঞা মোহাম্মদ রেজাউর রহমান ছিদ্দিকি’র সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জোনাকী টেলিভিশনকে বলেন, ইতোমধ্যে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান শপত নেওয়ার পরে সে এই পরিষদে থাকার বিষয়টি নির্ভর করবে। আর আমরা তার বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগগুলো পেয়োছ সেগুলো প্রমাণিত হলে তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
Leave a Reply