ডিসেম্বর বাঙালীর অহংকার ও গৌরবের মাস। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে এ মাসেই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতাকামী বাঙালীর চুড়ান্ত বিজয়। ৭১’ সালে দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতা যুদ্ধেরপর ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদারদের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে বিজয় লাভ করে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি দেশ আত্মপ্রকাশ করে। এমাসের ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকবাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে গোটা নরসিংদী পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি নরসিংদীবাসীর কাছে অত্যন্ত গৌরবোজ্জল ও স্মরণীয় দিন।
৭১’ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ওই খন্ড যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন জেলার ১১৬ জন বীর সন্তান। এর মধ্যে নরসিংদী সদরের ২৭, মনোহরদীর ১২, পলাশে ১১, শিবপুরের ১৩, রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলার ১৬ জন। এ ছাড়া বহু মা-বোনের নিরব আত্মত্যাগের বিনিময়ে নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকার সন্নিকটে অবস্থিত নরসিংদীতেও মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে থাকেনি। দেশ মাতৃকার ডাকে সারা দিয়ে ৭১’এর সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল জেলার আপামর জন সাধারণ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল তারা ।স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা মার্চ মাস থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে পাক বাহিনীর অন্তরাত্মা কাপিয়ে দেয়। মুক্তি বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী পাক হানাদার মুক্ত হয়। নরসিংদীর মুক্তি পাগল মানুষের মনে এ দিনটি আজও স্মরণীয় দিন।

৭১’এর মার্চে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। এতে হাজার হাজার ছাত্র জনতা তাদেরকে স্বাগত জানায়। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে শত শত যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ খবর পৌছ যায় পাক বাহিনীর কাছে। এখবরে ৪ এপ্রিল পাক বাহিনীর বোমারু বিমান নরসিংদী শহরে বোমাবর্ষণ শুরু করে। তখন গোটা শহরে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে শহীদ হন আবদুল হক ও নারায়ণ চন্দ্র সাহাসহ নাম না জানা আরো আট জন। ২৩ মে তৎকালীন মুসলীম লীগ নেতা মিয়া আবদুল মজিদ মুক্তি সেনাদের গুলিতে নিহত হন। পরে শুরু হয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও চোরাগুপ্তা হামলা। এরমধ্যে পাক বাহিনী নরসিংদী টেলিফোন ভবনে ঘাটি স্থাপন করে। স্থানীয় টাউট, দালাল ও রাজাকারদের যোগসাজসে হানাদার বাহিনীরা প্রতিদিন চালায় ধর্ষণ, নরহত্যা ও লুটতরাজ।
অপরদিকে বাংলার মুক্তি পাগল ছেলেরা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয় এবং আঘাত হানে শত্রু শিবিরে। নরসিংদী সদর উপজেলায় নেহাব গ্রামের নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে হানাদার প্রতিরোধ দূর্গ গড়ে তোলা হয়। ওই স্থান থেকে সমগ্র জেলায় মুক্তিযোদ্ধারা নিরলস ভাবে তৎপরতা অব্যাহত রাখে।
মুক্তিযোদ্ধে নরসিংদী জেলা ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। নরসিংদীকে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে নেওয়া হলে কামান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বিগ্রেডিয়ার (অব.) এএসএম নুরুজ্জামান । নরসিংদীকে মুক্ত করতে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা যে সব স্থানে যুদ্ধে অবর্তীণ হয়েছিলেন সে স্থান গুলো হলো, নরসিংদীর সদর উপজেলার বাঘবাড়ী, পালবাড়ী, আলগী, পাঁচদোনা, পুটিয়া, চলনদীয়া, মনোহরদী উপজেলার হাতিরদীয়া বাজার, রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর বাজার, রামনগর, মেথিকান্দা, হাটুভাঙ্গা, বাঙালীনগর, খানাবাড়ী, বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর বেলাব বাজার, বড়িবাড়ী ও নীলকুঠি নামক স্থানে।

এ সময় আড়িয়াল খাঁন নদীর পাড়ে বেলাব বড়িবাড়ীর নীলকুঠির যুদ্ধে হানাদারদের হাতে শহীদ হন সুবেদার আবুল বাশার, মমতাজ উদ্দিন, আব্দুস সালাম ও আব্দুল বারী। এ ছাড়া পাক হানাদার বাহিনীরা বড়িবাড়ী বাজনাবরের নিরীহ ৮/১০ জনকে ধরে এনে এক সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে এবং বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও অযত্ন আর অবহেলায় স্মৃতিসৌধটির এখন বেহাল অবস্থা। গরু, ছাগল, কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখা যায় স্মৃতিসৌধ বেদীতে। ভেঙে গেছে স্মৃতিসৌধের অনেকাংশ। এই এলাকার যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সুবেদার বাশারের লাশটি এলাকাবাসীর উদ্যোগে সমাহিত করা হলেও তাও ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্যে অযত্নে পড়ে আছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আজো অরক্ষিত জেলার বধ্যভূমিগুলো :
পাক বাহিনীরা রাজাকারদের সহযোগিতায় নরসিংদী জেলার ১৫টি বধ্যভূমিকে বিভক্ত করে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে ছিল। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো অযত্নে আর অবহেলায় রয়েছে নরসিংদীর বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি। দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আর তার পরিবারের উন্নতি হলেও উন্নত হয়নি ৭১’ হায়েনাদের হাতে নিহত বীর সেনাদের স্মৃতিচিহ্নগুলো।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা ব্রীজ সংলগ্ন এলাকা, শীলমান্দী মাছিমপুর বিল, খাটেহারা ব্রিজ, শিবপুরে ঘাসিরদিয়া, বেলাবরের আড়িয়াল খাঁ নদীর পাশে বড়িবাড়ি, রায়পুরার মেথিকান্দা রেল স্টেশনের পার্শ্ববতী স্থান ও মনোহরদী উপজেলার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখেছিল পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে এলাকাবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে চিহ্নিত জেলার ৩টি বধ্যভূমি হলো, নরসিংদী সদরের পাঁচদোনা, বেলাবর বড়িবাড়ি ও রায়পুরার মেথিকান্দা। এসব বধ্যভূমির মধ্যে পাঁচদোনা বধ্যভূমি এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। বড়িবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একটি স্মৃতিসৌধ। কিন্তু রায়পুরা বধ্যভূমিটি এখনও অরক্ষিত রয়েছে।

নরসিংদীর ৬ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান, প্রাক্তন মন্ত্রী প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূইয়া, প্রয়াত সাংসদ আফতাব উদ্দিন ভূইয়া, সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু, প্রয়াত সাংসদ মেজর (অব.) সামসুল হুদা বাচ্চু, সাবেক সাংসদ অধ্যাপক সাহাবুদ্দিন, সাবেক সাংসদ সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুল, সাবেক সাংসদ আব্দুল আলী মৃধা, নেভার সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, আজিজুর রহমান ভুলু, মজনু মৃধা, আব্দুল রাজ্জাক ভূইয়া, কাজী হাতেম আলী, প্রয়াত হাজী গয়েছ আলী মাস্টার, প্রয়াত নূরুল ইসলাম কাঞ্চন, আলী আকবর, মো: আমানুল্লাহ, সিরাজুল হক, তাজুল ইসলাম খান, অধ্যাপক মো: ইউনুছ, আব্দুল মোতালিব পাঠান, মীর এমদাদ, মো. নুরুজ্জামান, আব্দুল লতিফ, হাবিবুল্লাহ বাহার, নিবারন রায়, মনছুর আহম্মেদ, আলী আকবর সরকার, নুরুল ইসলাম গেন্দু, বাবর আলী মাস্টার, আবেদ আহমেদ, আব্দুল হাই, সমশের আলী ভূইয়া, মতিউর রহমান মাস্টার, আব্দুল মান্নান খান, তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, বিজয় চ্যাটার্জী ও সাদেকুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সরোজ কুমার অধিকারী, ড. সাদত আলী, মো: শহীদুল্লাহ, মো: সামসুজ্জামান ও মো: ফজলুর রহমান।
Leave a Reply