এডভোকেট মোঃ শহীদুল্লাহ শিকদার:
১৬ ডিসেম্বর জাতীর ইতিহাসে বিজয় ও গৌরময় দিন। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন আমাদের স্বাধীনতা মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার দরুন অস্তমিত হয়েছিল। সূদীর্ঘ ২১৪ বছর বহু সংগ্রাম, আন্দোলন ও বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। স্বাধীনতা মানে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তার্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক অধিকার এবং মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা।
বিশেষ উল্লেখ্য যে, আমরা ১৯৭১ সাল স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে কিছুদিনের জন্য একটি নেষ্টি স্বাধীনতা পেয়েছিলাম ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট। আমাদের বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান পাকিস্তান তথা পশ্চিম পাকিস্তন দুটি ভূ-খণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনতার অবদান ছিল বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই তারা আশা করছিল পাকিস্তানী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালী জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাবে প্রশাসনে সমতার ভিত্তিতে তাদের মুখ্য ভূমিকা থাকবে। কিন্তু অচিরেই মোহ ভঙ্গ হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা বাঙালি জাতি মৌলিক অধিকার ও ন্যায্য অধিকার ভাগ করা হতেও বঞ্চনার শিকার হয়। পাকিস্তানে ২৩ বছরে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়নি। যখন ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনোত্তরকালে ক্ষমতা হস্তাস্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অপতৎপরতার ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি তরানিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০-এ ২৩ বছরের পশ্চিম পাকিস্তনী অপশাসনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের মনে নানা অভিযোগ দানা বাধতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ছিল মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দূকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা। অভিযোগ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির। পূর্ব বাংলার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানী আয় ছিল কম। কিন্ত রপ্তানী আয়ের ৭০ ভাগেই পশ্চিম পাকিস্তানের খরচ করা হত। ৩য় অভিযোগ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির ৯ বছরেও কোন সংবিধান রচিত হয়নি। ১৯৫৬ সালে দায়সারা গোছের সংবিধান প্রণীত হলেও তাতে পূর্ব পাকিস্তানকে নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়। চাকুরী ক্ষেত্রে ছিল বিরাট বৈষম্য। ফলে তৎকালীন সামরিক প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বহু চাপের মুখে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধা হন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরর নির্বাচনে বাঙালি জাতি সংখ্যাগরিষ্টতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহনা শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের সাথে পশ্চিম পাকিন্তানের শাসকগোষ্টির শাসন ও শোষনের ক্ষেত্রে বিরূপভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে তার কিঞ্চিত বিবরণ নিন্মে তুলে ধরা হলো। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ২ কোটি অথচ রাজধানী ঢাকার স্থলে হলো কারাচি। এটি ছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্টির উপনিবেশবাদ কায়েমের সর্ব প্রথম হঠকারিতা। রাজধানীর অবকাঠামো তৈরিতে খরচ করা হল কোটি কোটি টাকা। এর পর করাচি থেকে রাজধানী স্থানাস্তর করা হয় রাওয়ালপিন্ডি, অত;পর ইসলামাবাদ। প্রতিবারে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। সে অনুপাতে বাংলাদেশ লক্ষ টাকাও খরচ করা হয়নি।
শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে চলে চরম বৈষম্যনীতি। নজির হিসাবে বলা যায়, ১৯৪৯-১৯৫১ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন খাতে বরাদ্ধকৃত ১৪২ কোটি টাকার মধ্যে ১২০ কোটি টাকাই খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের মনে এসব বৈষম্যের দরুন পুঞ্জিভূত হতে থাকে ক্ষোভ। এ ক্ষোভে-বিক্ষোভে রূপায়িত হয়ে ফেটে পড়ে। সবশেষে ৭০’-এর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে চলেবাহনা এক চরম আন্দোলনের সূচনা করে যার ফলশ্রুতি মুক্তি সংগ্রাম, চলে ৯ মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ৯ মাসের এ মুক্তিযুদেদ্ধর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হলো ৫৩ বছর। এখন আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে যে, যে লক্ষ্য ও আর্দশের জন্য বিপুল ত্যাগ,রক্তপাত ও অত্মহুতি দেয় হয়েছে সে গুলো অর্জিত হয়েছে কিনা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ন্যায় বিচার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক মুক্তি মানবাধিকার মুল্যবোধ, কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়ন দেখা যাবে বাংলাদেশে বিপ্লব এখনও সমাপ্তি লাভ করতে পারেনি। সকল ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণতা বিরাজমান। তার একমাত্র কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার, সহমর্মিতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব। কাজেই সবার দৃঢ় শপথ হোক মুক্তিযুদ্ধে যারা দেশ ও জাতির জন্য শহীদ হয়েছেন তাদের বিদেহী আত্মা যেন শান্ত পায় সে জন্য দেশের সার্বিক সমস্যা সমাধানে সকল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্যমত সৃষ্টি করা। হানাহানি, হিংসা বিদ্ধেস মন হতে দূর করে দেশ ও জাতির জন্য আন্তরিক ভাবে কাজ করা। রাজনৈতিক নেতা নেতৃবৃন্দসহ এদেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশার বস্তু ছিল যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু দেশবাসি জনগণ আজ দারুণ হতাশা নিমজ্জিত। নেতারা লুটপাটে লিপ্ত। দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র স্বাধীনতাকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আজো আমরা জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে পক্ষ বিপক্ষের বিভক্তির পয়জনাস শ্লোগানের মধ্যে ভাসছি। এ দুরাবস্তার অবসান হোক। নেতা নেতৃবৃন্দকে জনগণের স্বার্থের প্রতি আন্তরিক হতেই হবে। দেশও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় আন্তরিক না হলে জননেতা হওয়া যায় না।
লেখক: সাবেক সম্পাদক
নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতি
Leave a Reply