গাজীপুর প্রতিনিধি:
বাড়ির উঠানের এক পাশে মাটির ঘর। তাতে নেই কোনো দরজা জানালা। ঘরের এক কোনে রয়েছে ভাঙ্গা চৌকি। পাশেই পুঁতা রয়েছে কাঠের খুঁটি। চৌকির উপর বসে থাকা বৃদ্ধকে কোমরে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ওই খুঁটির সাথে। শোয়া বসার জায়গা নেই। বৈদ্যুতিক পাখা, বাতিহীন অন্ধকার ঘরে এভাবেই কেটে গেছে ৩৬ বছর। শিকলে বাঁধা জীবনের যৌবন পার করে এখন বৃদ্ধ সাফাজ উদ্দিন (৬০)।
শিকলেবন্দি সাফাজ উদ্দিন মোল্লা গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের মৃত রজব আলী মোল্লার ছেলে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার মূলাইদ গ্রামে মোল্লা বাড়ির উঠানের এক পাশে মাটির ঘর। বাহির থেকে চট দিয়ে দু’টি জানালা, একটি দরজা বন্ধ রয়েছে। ঘরের ভেতর ঘুট ঘুটে অন্ধকার। নেই কোন আলোর ব্যবস্থা। এক পাশে রয়েছে বাড়ির অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। অন্য পাশে রয়েছে একটি ভাঙ্গা জরাজির্ণ চৌকি। চৌকির এক কোনে রয়েছে ময়লা ও ছেড়া একটি বালিশ। এতে মাথার স্পর্শ লাগেনি হয়তো বহু বছর। অ-পরিস্কার পাত্রে রয়েছে কিছু ভাত। রংয়ের পটে রয়েছে পানি। ভাঙ্গা চৌকির এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে নির্বাক বসে আছেন সাফাজ উদ্দিন। ঘরে ঢুকতেই ফেল ফেল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন তিনি।
বিরবির করে কি যেন বলতে চাইছিল, ঠিক মতন বুঝা যাচ্ছিলনা তা। মুখে লম্বা দাড়ি ও গোপ, মাথায় লম্বা চুল। পড়নে ছেড়া মলিন জামা কাপড়। গায়ে জড়ানো পুরাতন মলিন চাদর। ঘরের ভেতর দুর্গন্ধ। হয়তো গোসল করেনি অনেক দিন। অনাহার, অনিদ্রায়, অপুষ্টিতে চোখ দু’টি দেবে গেছে। যুগ যুগ ধরে শিকল বন্দি হয়ে আলো বাতাসহীন বদ্ধ ঘরে এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার দিন। বৃদ্ধ বয়সে এখন পরে আছেন অবহেলা অনাদরে। অমানবিক পরিবেশে বিনা চিকিৎসায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাকে।
মোল্লাবাড়িতে গিয়ে সাফাজ উদ্দিনের কথা জানতে চাইলে কথা হয় তার বড় ভাই আফাজ উদ্দিন মেল্লার সাথে। তিনি জানান, তারা ৫ ভাই ৪ বোন। আফাজ উদ্দিন মৃত রজব আলীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান। তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা রজব আলী ছায়তুন নেছাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার সেই মায়ের গর্ভে জন্ম নেয় সাফাজ উদ্দিন সহ ৪ ভাই ৪ বোন। সকল ভাই বোনদের মধ্যে সাফাজ উদ্দিন দ্বিতীয়।
তিনি আরও বলেন, সাফাজ উদ্দিনের মাথায় জটা ছিল। বিয়ের পর তার স্ত্রী কৌশলে চুলের জটা কেটে ফেলে। এরপর থেকেই সে অস্বাভাবিক হয়ে পরে। এরই মধ্যে তার মেয়ে ঝর্ণা আক্তারের জন্ম হয়। কিছুদিন পর অসুস্থ্য স্বামীকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেন সাফাজ উদ্দিনের স্ত্রী। প্রায় তিন যুগ ধরে শিকল বন্দি আছে সাফাজ উদ্দিন।
সাফাজ উদ্দিনের এক মাত্র মেয়ে ঝর্ণা আক্তার । মামারাই লালন পালন করে বিয়ে দেন তাকে। ছোট বেলা থেকেই দেখছেন তার বাবা শিকল বন্দি। যখন বুঝতে শিখেছেন তখন জানতে পারেন তার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। চাচারা বাবার কি চিকিৎসা করিয়েছে তার কোন প্রমান নেই। বহু বছর ধরে বাবা তার বিনা চিকিৎসায় পরে আছে। বাবা অসুস্থ্য তাই তার জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র হয়নি। এনিয়ে তিনি নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে।
ঝর্ণা আক্তারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার স্বামী ইট ভাটার লড়ি চালক। স্বামীর সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানোর পর বাবার বরণ পোষণ জন্য কিছুই দিতে পারেন না। দাদা রেখে যাওয়া জমি তার বাবা ভোগ দখল করতে পারছেন না। বিক্রিও করতে পারছেন না। বিনা চিকিৎসায় দূকছে তার বাবা। বাবার এমন দূর্ভোগের জীবন দেখে শুধুই চোখের জল ফেলেন মেয়ে ঝর্ণা। প্রায় ৩ যুগ ধরে তার বাবা শিকলবন্দি হয়ে অন্ধকার ঘরে অমানবিক পনিবেশে দিন কাটাচ্ছে। ভাঙ্গা চৌকিতে তার দিন কাটে বসে থেকে। শোয়ার মতো সামান্য এতটুকু জায়গা নেই তাতে।
সাফাজ উদ্দিনের বৃদ্ধা মা ছায়তুন নেছা (৮০) জানান, তার স্ত্রী নেই। কেও দেখাশুনা করেনা। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ছেলেকে ফেলে দিতে পারেন না। এ ভাবেই যুগ যুগ ধরে বেধে রেখে ভরণ পোষণ দিচ্ছেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো: মোবারক হোসেন জানান, সাফাজ উদ্দিন আমার অতি পরিচিত ও আত্মীয়। বহুবছর ধরে সে অসুস্থ্য। তার একটি মেয়ে আছে। সাফাজ উদ্দিনের মানবিক জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।
উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মো: মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। আমি সরেজমিনে গিয়ে সব খবরাখবর নিয়ে এব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ ব্যবস্থা নিব।
Leave a Reply