1. mostafa0192@gmail.com : admin2024 :
  2. arswaponbd6@gmail.com : বার্তা বিভাগ : বার্তা বিভাগ
মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪১ পূর্বাহ্ন

সার্বজনীন দুর্গোৎসব; দশভূজা দুর্গা

মোঃ শাহাদাত হোসেন রাজু
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০২১
  • ১৭৫০ বার পঠিত

শরৎ মানেই পরিষ্কার নীল আকাশে ভেসে চলা সাদা সাদা তুলোর মত মেঘ। ভোরে ঘাসের ডগায় জমতে থাকা শিশিরবিন্দুর মধ্যে সাদা শাড়িতে কমলা আঁচল বিছিয়ে শিউলি ফুলের সজ্জা। সেই সঙ্গে বাংলায় শরৎ মানেই ঢ্যাম কুড় কুড় ঢাকের তালে আলতা রাঙা পায়ে শারদীয় বার্তা নিয়ে দেবী দূর্গার আগমন।

রবি ঠাকুরের ভাষায়,
‘শরত-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে॥
তারি সোনার কাঁকন বাজে আজি প্রভাতকিরণ-মাঝে,
হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি- ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে॥’

বাংলার অন্যতম বড় এই উৎসবে প্রকৃতিও যেন সেজে ওঠে অন্যন্য উপায়ে। শরৎ মানেই যেন আকাশ আর মাটির মেলবন্ধন। ঘন সবুজ কাশের বনে আকাশের কয়েক টুকরো মেঘ যেন উড়ে এসে কাশফুল হয়ে ফুটে থাকে। আশ্বিনের শুক্লপক্ষে দেবী আসেন দশভূজা রূপে, সিংহের পিঠে অধিষ্ঠান হয়ে। হিন্দু ধর্মমতে, দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি দুর্গা। অন্য মতানুসারে দুর্গম নামের অসুরকে বধের কারণে তাঁকে দূর্গা নামে ডাকা হয়।

বাঙালি হিন্দু  সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয়,  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এটা সার্বজনিন উৎসব। আনন্দময়ী দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার আগমন বার্তায় চরাচর আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। এ বছর ১০ অক্টোবর পঞ্চমী তিথির সন্ধ্যায় দেবীর বোধন করা হয়েছে। আর  ১১ অক্টোবর ভোরে কলাবউ স্নানের মধ্যে দিয়ে যাবতীয় মলিনতা, অন্ধকার দূরে সরিয়ে চারদিনের মহোৎসবের শুভ সূচনা হয়েছে।

বাঙালির আটপৌরে সংসারে হাজারো না পাওয়ার হতাশা, ব্যর্থতা এবং বিপর্যয়কে অতিক্রম করে ১৫ অক্টোবর বিসর্জন পর্যন্ত আগামী একবছর নতুন করে চলার শক্তি ও অনুপ্রেরণা দুইই জোগায়। সব ভুলে মানুষ ডুব দেয় আনন্দ সমুদ্রে কোনও উজ্জ্বল আলোর অপেক্ষায়। এখানে যেন ধনি-দরিদ্র কোনও ভেদাভেদ নেই। সবাই নিজেকে ছাপিয়ে এই পাঁচটি দিনের আনন্দ-প্রসাদ তাই চেটেপুটে নিতে তৎপর। এই আনন্দযজ্ঞে শামিল হয়ে সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া দেবীর আরাধ‍্যের সামিল।

ধরে নেওয়া হয়, খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম মহা আড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন। 

বাংলার অন্যতম বড় এই উৎসবে প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে সেজে ওঠে উৎসবমুখর বাঙালি। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও এখনও মেয়েরা পরেন রঙ-বেরঙের শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি-ধুতি বা ফতুয়া।

শারদীয় দুর্গোৎসবকে অকাল বোধন বলা হয়। অর্থাৎ অকালে দেবী দূর্গাকে জাগানো হয়। হিন্দু শাস্ত্রমতে সমস্ত বছরকে উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ন এই দুটি কালে ভাগ করা হয়। মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত সময়কে দক্ষিণায়ন কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উত্তরায়ণ কালে দেবদেবীগণের জাগ্রত কাল এবং দক্ষিণায়ন দেবদেবীর নিদ্রাকাল। রামচন্দ্র যুদ্ধের প্রয়োজনে অকালে দেবীকে বোধন অর্থাৎ স্তব-স্তুতির মাধ্যমে জাগরণ ঘটিয়ে দুর্গাপূজো করেছিলেন। এ কারণে শারদীয় দুর্গাপূজাকে অকাল বোধন বলা হয়। দেখা যায় দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য বেলতলায় মহাদেবের স্তবকরে অনুমতি নিয়ে বোধন ঘটাতে হয়।

আসলে দুর্গাপূজা বললেও এই পূজা মা-দুর্গার একার নয়। সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন। মা দুর্গা আসেন সবাইকে নিয়েই৷ ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, গাছ-প্রাণী সঙ্গে নিয়েই। চালচিত্রে শিব আছেন, তো পায়ের নিচে অসুর। কলাগাছ বউ তো পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, ময়ূর বাহন। হাসিকান্না, সুজন-দুর্জন, পশুপক্ষী-উদ্ভিদ সমাহারে আমাদের জীবন-পথ চলাটাকেই সহজ করে চিনিয়ে দিতে চান৷

দেব-দেবী মানুষের কল্পনা মাত্র। নিজের কল্যাণ কামনায় এবং অপশক্তি বধে মানুষ যুগে যুগে নানা দেব-দেবীর কল্পনা করেছে। এই কল্পনার রূপটিই ধরা পড়ে দুর্গাপরিবারের চিত্র দেখলে। দুর্গাপরিবারের চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, মা দুর্গা মহিষাসুরের সঙ্গে ধুন্ধুমার লড়াই করছেন, অথচ তার ছেলেমেয়েরা নিতান্ত উদাসীন ভাবে পাশে দাঁড়িয়ে। সুদর্শন কার্তিক তার অস্ত্র তোলেন না, গণেশের মুখে তো একটা হাসির আভাস, লক্ষ্মী নিজের ঝাঁপিটা আরও শক্ত করে চেপে ধরেন, সরস্বতীও বীণা হাতে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকেন। এই অদ্ভুত দৃশ্যের অর্থ বুঝতে ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে।

দুর্গার নাম প্রথম পাই বৌধায়ন এবং সাংখ্যায়নের সূত্রে। আমাদের মহাকাব্যগুলোতে ইতস্তত দেবী, শক্তি ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু দশভুজা যুদ্ধরতা দেবীর বিশেষ কোনও খবর সেখানে নেই। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে আছে, অর্জুন দুর্গার পূজা করছেন। স্কন্দ-কার্তিকের মহিষাসুর নিধনের কথাও আছে। কয়েকটি পুরাণে দুর্গার উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু হিন্দু দেবদেবীদের মধ্যে তিনি যথার্থ গুরুত্বের আসনে নেই।

ব্যাপার হলো, দুর্গা সম্পর্কে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ লিখিত বিবরণ পাই গুপ্তযুগের পরে। বাংলায় আর একটু পর থেকেই দেবীর নানান রূপ সম্পর্কে লেখা ও ভাস্কর্য আসতে শুরু করে, কিন্তু আজকের এই প্রতিমার রূপটিতে পৌঁছতে আরও কয়েক শতাব্দী লেগে গিয়েছিল। পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাসী রামায়ণে যুদ্ধরতা দেবী এবং রামচন্দ্রের অকালবোধন সম্পর্কে প্রচলিত নানান লোককাহিনিকে প্রথম একসূত্রে গাঁথা হলো, তৈরি হলো তার প্রথম নির্দিষ্ট বিবরণ, যাকে আগমার্কা বাঙালি কাহিনি বলতে পারি।

আশ্বিন-কার্তিকে দুর্গাপূজার ব্যাপারটা একেবারেই এই অঞ্চলের কৃষির সঙ্গে জড়িত। এখানে আমন ধান আসার অনেক আগে থেকে আউশ ধানের প্রচলন ছিল, সেই ধান পাকার সময়েই এই পূজা। মহিষের ব্যাপারটা সম্পর্কে প্রচলিত মতো হলো, এই প্রাণীটি নিচু জমিতে বাস করতো, এই অঞ্চলে চাষের প্রসারের জন্য কৃষিজীবী মানুষ ক্রমশই মোষ তাড়িয়ে মেরে জমি দখল করে। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার আরাধনা হয়তো এই মহিষ নির্মূল অভিযানকে একটা ধর্মীয় বৈধতা দেওয়ার কৌশল ছিল, বিশেষ করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বা কংসনারায়ণের মতো জমিদারদের পক্ষে, যাঁদের সমৃদ্ধির মূলে ছিল কৃষির প্রসার।

রমাপ্রসাদ চন্দ এবং প্রবোধচন্দ্র বাগচী বলছেন, সিংহবাহিনী দুর্গাকে গুপ্তযুগের পরে বাংলায় বাইরে থেকে আমদানি করা হয়, কিন্তু অন্যদের মতে এই অঞ্চলেই তাঁর উৎপত্তি। এক অর্থে দুটো মতই ঠিক, কারণ এই দুর্গার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আছে, আবার বহিরাগত উপকরণও আছে। কিছু কিছু দুর্গামূর্তিতে দেখা যায়, সিংহের বদলে দুর্গার বাহন হলো গোধিকা বা গোসাপের মতো একটি প্রাণী, কালকেতুর কাহিনিতে যার কথা আছে। লক্ষণীয়, গোসাপ অনেক বেশি প্রাকৃত, সিংহ সে তুলনায় সংস্কৃত প্রাণী। উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার পটুয়া ও চিত্রকররা সিংহটাকে ঠিক বাগে আনতে পারতেন না, কারণ তাঁরা তো জীবনে এই প্রাণীটিকে দেখেননি। উত্তর ভারতে আবার দেবী এখনও রয়াল বেঙ্গল টাইগারের পিঠে, ‘শেরাবালি’। মজার ব্যাপার বটে।

ইন্দোনেশিয়ায় বোরোবুদুর, সুরাবায়া, বান্দুং-এর মতো কিছু জায়গায় ছয় বা আট হাত বিশিষ্ট দুর্গার দেখা মেলে। জাভার একটি লিপিতে দেখা যায় এক রাজা যুদ্ধের আগে এই দেবীর পূজা করেছিলেন। জাভায় পনেরো ও ষোলো শতকে দুর্গাকে রক্ষয়িত্রী হিসেবে আরাধনার প্রবল প্রচলন হয়।

দুর্গার ছেলেমেয়েদের কথায় ফিরি। স্পষ্টতই, রণরঙ্গিণীকে সংসারে বেঁধে ফেলে বশ মানাতে এবং মাতৃসুলভ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পিতৃতন্ত্র ক্রমশ ছেলেমেয়েদের যোগ করেছে। তৎকালীন কুমিল্লার দক্ষিণ মুহম্মদপুরে পাওয়া একটি দ্বাদশ শতকের মূর্তিতে দুর্গার সঙ্গে গণেশ ও কার্তিক আছেন, মেয়েরা নেই। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরসীকুমার সরস্বতী এবং এনামুল হকের মতো ইতিহাসবিদরা অনেক চেষ্টা করেও চার ছেলেমেয়ে সংবলিত দুর্গার একটিও প্রাচীন ভাস্কর্য খুঁজে পাননি।

ধরে নেওয়া যায়, মেনকা এবং গিরিরাজের বাৎসল্য শেষ অবধি দুর্গাকে তাঁর বাপের বাড়িতে টেনে আনে। এবং আসতেই যদি হয়, তিনি কী করে চার সন্তানকে ফেলে আসেন? আর, বেচারি রক্তস্নাত মহিষাসুরকে সঙ্গে না আনলেও কি চলে? মেনকা যখন দেখলেন, তাঁর মিষ্টি মেয়েটা একেবারে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোজা চলে এসেছে, দেখে চেনাই যাচ্ছে না, তখন তো তিনি একেবারে হতবাক। দাশরথি রায় এবং রসিকচন্দ্র রায়ের মতো কবিরা সেই দৃশ্যের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।

পৌরাণিক কাহিনি থেকে দুর্গা পূজার শুরু। কিন্তু ক্রমে দুর্গা যেন বাঙালির ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছে। সাধারণ মেয়ে, তবে দাপুটে। এই দাপুটে মেয়ের কত নাম! এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহুনামে চিহ্নিত আমাদের মা দুর্গা। শরৎঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চণ্ডী, শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা এমন কত নাম আছে মায়ের। ঠিক নানী-দাদীরা যেমন আমাদের আদর করে একটা নামে ডাকে, মামারবাড়িতে আদিখ্যেতা করে অন্য নামে ডাকা হয়। আবার বাবার দেওয়া একটা নাম, মায়ের দেওয়া একটা নাম, স্কুলের জন্য একটা ভালো নাম । মা দুর্গারও তেমনি অনেক নাম। সে তো আমাদেরই ঘরের মেয়ে!

আমরা যদি চণ্ডীর দেবীনির্মাণের ব্যাখ্যা ধরি, নানা শক্তি সমন্বয়ে আজকের ভাষায় তিনি একটি বিশেষ কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো যন্ত্র, একজন নারীবেশী যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কিছু নন। অসুরের মধ্যে পুরুষের তথাকথিত নারীশরীরের লোভ সঞ্জাত করেছিলেন পৌরাণিকরা। তাই দুর্গা নামের যুদ্ধাস্ত্রটি স্ত্রী রূপে শোভিত, এক পুরুষকে প্রলোভন দেখাবে বলেই। যদিও আমাদের ঘরের মেয়ে বা লৌকিক দুর্গার সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির তেমন কোনও মিল নেই। লৌকিক দুর্গা বাঙালির ঘরের মেয়ে, চলতি তথাকথিত মেয়েলি সব বৈশিষ্ট্য তাঁর অধিকার।

 

মা’কে যেমন একাহাতে অনেক কাজ করতে হয়, ঠিক যেমন মাদুর্গাকে দশহাতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল মহিষাসুর বধের সময়। সব দেবতা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল মাদুর্গাকে। অনেকগুলো দৈত্য, দানব, অসুরকে তিনি মেরেছিলেন। আমরা শুধু মহিষাসুরের নামটাই জানি। রক্তবীজ, চণ্ড, মুণ্ড, শুম্ভ, নিশুম্ভ, ধূম্রলোচন, মধু, কৈটভ আর মহিষাসুর, মোট ন’জন অসুরকে মাদুর্গা বধ করেছিলেন।

এই এক একজন দুষ্টু অসুর আসলে সমাজের খারাপ লোকেদের প্রতীক। ধরে নেওয়া যায়, অসুরের একজন চোর, একজন ডাকাত, একজন মিথ্যেবাদী, একজন হিংসুটে, একজন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে, একজন অসৎ, একজন খুনি, একজন প্রতারক আর একজন নিষ্ঠুর লোক। এরা সকলেই দুষ্টু আর সমাজের জন্য ক্ষতিকারক মানুষ। তাই বছরে একবার মা দুর্গাকে স্মরণ করে আমরা এইসব অশুভ শক্তির বিনাশ করার চেষ্টা করি।

আমরা যেমন ঘর-সংসার, স্বামীসন্তান, আত্মীয় পরিজন ছাড়া কোনও কিছু চিন্তা করতে পারি না, আমরা দুর্গার ক্ষেত্রেও তাই দেখতে চেয়েছি। লৌকিক দুর্গা আমাদের মাঝে দেখা দেন সপরিবারে। বাঙালির আপন মনের মাধুরী মেশানো দুর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে কৈলাশ থেকে হিমালয়ে বাপের বাড়ি আসেন। বাঙালির ঘরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতো আনন্দ। যেমন– পরিবারে সবাই আপন, সেরকম জগজ্জননীর বিশ্বসংসারে আমরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী বৈশ্য, শাসনকর্তা- সবাই বিশ্বজননীর সন্তান– সরস্বতী, কার্তিক, লক্ষ্মী ও গণেশের মতো সবাই আপন। সন্তানদের কল্যাণের জন্য মা দুর্গা সর্বদাই উদগ্রীব। তাই ১০ দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধরেছেন।

তবে বাঙালি যেভাবে দুর্গা পূজাকে আত্মস্থ তথা জীবনের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছে, তেমন ভাবে আর কেই করতে পারেনি। মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে মা দুর্গা যেমন বাঙালির অন্তর জুড়ে বিরাজ করছেন, তেমনি কন্যারূপে উমা বাঙালির সংসারে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করেছে। কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর স্ত্রী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। বৎসারান্তরে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা যেন প্রতিটি বাঙালি পরিবারের সর্বজনীন প্রার্থনায় পরিণত। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে–তাই বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে দেখা দেয় আনন্দের শিহরণ। আমাদের এই দুঃখ-দৈন্যের ঘরে শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে আসবে মাত্র চার দিনের জন্য–তাই আর সমস্ত দুঃখ ভুলে ঘরে ঘরে আনন্দের পসরা সাজায়, নতুন জামা কাপড় পরে দুঃখকে বিদায় দিয়ে আনন্দময় হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। এভাবে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। মা দুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙালির আগমনী সংগীত আমাদের জীবনপ্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা। এর তাৎপর্য হৃদয় দিয়ে, গভীর বোধ দিয়ে অনুভব করতে হয়। ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাসের বাইরের এ বোধ। এটাই চিরন্তন মানবিক মূল্যবোধ।

সবাই মিলে নিরুপদ্রপে ইচ্ছে মতো পূজার আনন্দে সামিল হতে পারলে উৎসব তার প্রকৃত তাৎপর্য ফিরে পাবে। আর এখান থেকেই নতুন করে আগামী একবছর চলার শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে মানুষ আবার নতুন করে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে। সংসারের সব অসুরকে হারিয়ে নতুন এক উজ্জ্বল, উচ্ছ্বল জীবনবোধে উদ্বেল হয়ে শুরু হবে নতুন করে পথ চলা।

দূর্গা পূজা শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়, বাংলার ঐতিহ্যের মিশেলে এই উৎসব সার্বজনীন। তাই তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পূজামন্ডপ আর পূজা ঘিরে চলা মেলায় ভিড় জমে বাঙালির। নানা রুপে, নানা সাজে শারদীয়া দুর্গোৎসব তাই বাঙালির অন‍্যতম আনন্দের উপলক্ষ এবং উৎসব।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 Jonaki Media and Communication Limited
Design By Khan IT Host