নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মরজালে অবস্থিত ওয়ান্ডার পার্কে ঘুরতে আসা বিনোদন প্রেমিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন এই সময়ে মাস্ক পড়ার নেই কোন বাধ্যবাধকতা। নোংরা, অপরিছন্ন পরিবেশ এবং পার্কের উত্তর পশ্চিমাংশে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় ও মুরগির ফার্মের দুর্গন্ধ সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তুলছে। তাছাড়ার বিনোদন কেন্দ্র নয় দিন দিন পার্কটি অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দেওয়া তরুণ-তরুনীদের ডেটিং স্পটে পরিনত হয়েছে।
নরসিংদী জেলা সদর থেকে ১৫ কি.মি এবং রায়পুরা উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বে মরজাল এলাকায় অবস্থিত ওয়ান্ডার পার্ক। নরসিংদী ও আশপাশ জেলাগুলোর বিনোদন প্রেমিদের কথা ভেবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে প্রায় আধা কিলো ভিতরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ওয়ান্ডার পার্ক’ নামক এই বিনোদন কেন্দ্রটি।
সম্প্রতি জোনাকী টেলিভিশনের টিম প্রতিবেদন করতে ওয়ান্ডার পার্কে গেলে, এই প্রতিবেদকের হাতে চ্যানেলের লোগুসম্বলিত মাইক্রোফোন দেখলেও প্রবেশদ্বারের একজন ‘কোথা থেকে এসেছেন’ বলে প্রতিবেদকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। প্রতিবেদক কোন কিছু না বলে তার ভিজিটিং কার্ডখানা প্রশ্নদাতার দিকে বাড়িয়ে দেন। তিনি সেটা কাউন্টারে দেখাতে বলেন। যথারীতি প্রতিবেদক কাউন্টারে বসা লোকটা হাতে দিলে তিনি পার্কের ম্যানেজারের একটি ভিজিটিং দিয়ে ফোন করতে বললেন। প্রতিবেদক ভিজিটিং কার্ডটি হাতে নিয়ে পার্কে ম্যানেজার সৈয়দ ইমরান হোসেন সজীবের ০১৭২২-৬০০৪১৫ মোবইল নাম্বারে ফোন দিয়ে নাম পরিচয় ও আগমনের হেতু বর্ণনা করেন। ওপাশ থেকে বললেন, ‘এখন আমরা কোন প্রতিবেদন করাবো না আপনার নাম্বারটা আমি সেইফ করে রাখছি। সামনে আমাদের সিজন তখন আপনাকে ডাকব।’ প্রতিবেদক তখন ম্যানেজারকে বললেন, প্রতিবেদন আপনাদের জন্য নয় আমার চ্যানেলের জন্য।’ ম্যানেজার এর প্রতি উত্তরে বললেন না কোন প্রতিবেদন করা লাগবেনা। প্রতিবেদক পাল্টা উত্তরে বললেন, আমার প্রতিবেদন আমি করবো তাতে আপনার বাধা কোথায়? আমি টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকব। এই বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেয়। প্রতিবেদক কাউন্টারে গিয়ে টিকেটের মূল্য জিজ্ঞেস করতে গেলে কাউন্টারে বসা লোকটি প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনাকে না নিষেধ করা হয়েছে। তখন প্রতিবেদক কাউন্টারের লোকটাকে বলেন, আমি টিকেট কেটে ভিতরে যাব এখানে নিষেধ করার কি আছে। কাউন্টারম্যান জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে প্রতিবেদককে বলে উঠলেন, জানেন এটা কার পার্ক, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তার। তার কথায় পার্কের ভিতরের ঢুকার অনেকটা জিদ চেপে বসল প্রতিবেদকের। প্রতিবেদক উত্তরে বললেন সেটা যার ইচ্ছা তার হোক আমার তাতে কিছু আসে যায়না, আপনাকে টিকেট দিতে বলেছি টিকেট দেন। কাউন্টারম্যান কথা না বাড়ি ফোন দিল ম্যানেজারকে তার অনুমতি নিয়ে প্রতিবেদককে বললেন, ‘কয়জন।’ প্রতিবেদক জানালেন তারা ৩ জন। তখন সে, ছয়শ টাকা দিতে বলল। প্রতিবেদক দুইটা পাঁচশ টাকার নোট দিলে কাউন্টারম্যান মোট ৯টা টিকেট ও চারশ টাকা ফেরত দেয়।এতগুলো টিকেট হাতে নিয়ে অবাক হয়ে কাউন্টারম্যানকে জিজ্ঞেস করে এতো টিকেট কেন। তখন সে বলে, তিনটে হচ্ছে এন্টি ফি এর টিকেট আর ছয়টি দুটো রাইডসের যা বাধ্যতা মূলক। প্রতিবেদক পার্কের প্রবেশদ্বারে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণে পার্কের ভিতর প্রবেশ করার সময় মাস্ক পড়তে বাধ্য করা হয়নি। নিদেন পক্ষে কাউকে মাস্ক ব্যবহারের কথা বলতেও শুনেননি। টিকেট হাতে নিয়ে কোন কথা না বলে প্রতিবেদক তার টিম নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
ভিতরে প্রবেশ করে দেখা গেলো করোনাকালীন সময়ে সর্বত্র মাস্ক পড়া বাধ্যতা মূলক হলেও, এখানে যেন না পড়াটাই ফ্যাশন। আর পার্ক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে দর্শণার্থীদের জন্য নেই কোন নির্দেশনা বা বাধ্য-বাধকতা। মাস্ক ছাড়াই সকল দর্শাণার্থীরা অবাধে পার্কের ভিতর প্রবেশ করছে। নূন্যতম কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মাস্ক ব্যবহারের অনুরোধও করা হচ্ছে না বলেই বিনোদন প্রেমিদের এর প্রতি উদাসীনতা দেখা গেছে।
সারোয়ার খান নামে মাস্ক পড়া এক ভদ্রলোককে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালীপনা এখানে মাস্ক ছাড়াই সকলে ভিতরে প্রবেশ করতে পাচ্ছে। করোনাকালীন এই সময়ে স্বাস্থ্য বিধি মেনে পার্ক চালানোর শর্তে তা খুলে দেওয়া হলেও এখানে এসে দেখছি তা মোটেও মানা হচ্ছেনা।
পার্কে প্রবেশকালে এন্টি ফি একশ টাকা হলেও অনৈতিকভাবে এর সাথে দুটি রাইডস বাধ্যতা মূলক জুড়ে দিয়ে নেওয়া হচ্ছে দুইশ টাকা। যার ফলে বিনোদন কুড়াতে আসা সাধারন লোকজন প্রবেশ করতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে বিষয়টি অনুধাপন করার চেষ্টা না করলেও আবার অনেকেই তা ভালভাবে নিচ্ছেনা। অনেক বিনোদন প্রেমির বলছে এই পার্কে রাইডসের সংখ্যা মাত্র ৩ টি। তার মধ্যে বাধ্যতামূলক ভাবে দুটিরই টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এখানে দর্শণার্থীদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি খর্ব করা হয়েছে।
জুনায়েদ হোসেন নামে পরিবার পরিজন নিয়ে আগুগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখানে আমাদের পছন্দের কোন মূল্যায়ন করা হয়না। আমাদেরকে যে দুটো রাইডসের টিকেট দেওয়া হয়েছে তার একটিতেও আমরা কেউ এখনও চড়িনি। আমার মন চাইছে ওয়াটার বোটে উঠতে, কিন্তু এতে উঠতে তিনশ টাকা লাগবে। এ মূহুর্তে আমি আর অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে চাইছিনা। ওই দুটি রাইডসের টাকা যদি বাধ্যতামূলক করা না হতো তবে বোটে চড়েও আমার আরও কিছু টাকা বাঁচতো।’
পার্কে ভিতরের ঢুকলে নজরের আসবে কিছু উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী জুটিবদ্ধ হয়ে ঝোপঝাড়ে বা ছোট ছোট খুপ্টি ঘরগুলোতে অন্তরঙ্গ ভাবে বসে বা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। আর তা দেথে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসা ভদ্র পরিবারের লোকজন লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে মাধবদী থেকে সপরিবারে ঘুরতে আসা হারাধন সাহা বলেন ‘চাঁদপুর থেকে আমার শালী তার ননদদের নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে আসলে আমার পরিবারসহ তাদের সবাইকে নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছি। পার্কেটি মোটামুটি ঘুরার মত হলেও ওই যে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের কাজকর্ম একটু দৃষ্টিকটু লাগছে।’
পার্কের পশ্চিম উত্তর পাশে নেই কোন সীমানা প্রাচীর। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এ পাশটায় আবর্জনা ফেলে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। এছাড়া ডেমু ট্রেনে উঠতে এর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালে বয়লার মুরগির বিষ্ঠার দূর্গন্ধে পেটের ভিতর থেকে সব বের হয়ে আসার জোগাড় হয়।
এব্যাপারে নরসিংদীর ভেলানগর থেকে ঘুরতে আসা সারোয়ার খান নামে ওই ভদ্রলোক বলেন, পার্কের এ পাশটা নোংরা আবর্জনা ফেলে পুরো পার্কের পরিবেশ নষ্ট করেছে। তাছাড়া ডেমু ট্রেনে উঠতে গেলেই বয়লা মুরগির বিষ্ঠার দূর্গন্ধ নাকে এসে লাগে যা এখানে ঘুরতে আসা যেকোন মানুষের স্বাস্থ্য ঝুকির কারণ হতে পারে।’
ক্যামেরার সামনে কথা বলতে নারাজ এমন পার্কের আশপাশ এলাকার বেশ কয়েকজন জানায় (ভয়েজ রেকর্ড আছে) সন্ধ্যা নামলেই পার্ক এলাকার চিত্র পাল্টে যায়। পুরো এলাকায় নেমে আসে নিরবতা। আর এসময় প্রায় প্রতিদিনই মাইক্রোবাস, সিএনজি ও প্রাইভেটকার যোগে পার্কে কিছু লোকজনের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। তারা মধ্যরাত পর্যন্ত এখানে আমোদ ফুর্তিতে মেতে থাকে। ধারনা করা হচ্ছে এই পার্কের ভেতরে একাধিক ঘর রয়েছে, সেগুলোতেই রাতের বেলায় আগন্তকদের অসামাজিক কার্যক্রম চলে। এই কাজের সাথে স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত রয়েছে বলেও জানায়।
সবশেষে বলা যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন সময়ে সর্বাবস্থায়, সর্বত্র মাস্ক ব্যবহারে সরকারী নির্দেশনা থাকলেও মরজাল ওয়ান্ডার পার্কে তা মানা হচ্ছে না। বাধ্য করা হচ্ছেনা ঘুরতে আসা বিনোদন প্রেমিদের। এ পার্কে বেড়াতে এসে মাস্ক বিহীন মানুষের সঙ্গে একে আপরে কথা বলে, ময়লা আবর্জনাসহ বয়লার মুরগির বিষ্ঠার দূর্গন্ধে স্বাস্থ্য ঝুকিতে বিনোদন প্রেমিরা। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের বেহাল্লাপনা পিকনিক স্পট নয়, বরং ডেটিং স্পট হিসেবে পার্কটি দিন দিন অনৈতিক কার্যক্রমের যেন এক আড্ডাখানায় পরিচিতি পেয়েছে।
এব্যাপারে কথা বলতে পার্কের ম্যানেজার সজীবের মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদক ফোন দিয়ে কিছু তথ্য জানার আছে বললে, সাথে সাথে তিনি ফোনটি কেটে দেন। এরপর কয়েক বার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পরে পার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক লায়লা কানিজ লাকির মোবাইল ফোনে দুই/তিনদিন ধরে কয়েক দফা চেষ্টা করার পর তিনি ফোন রিসিভ করেন। প্রতিবেদক তার নাম পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য তাদের কাছ থেকে পূর্ব অনুমতির কথা জানতে চাইলে তার মুখ থেকে আসল কথা বের হয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন হিন্দু সাংবাদিক এখানে ঘুরতে এসে পার্কের নামে আজেবাজে তথ্য উপস্থাপন করে একটি প্রতিবেদন করে। সেজন্যই অপরিচিত কোন সাংবাদিককে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়না।’
এন্টি ফি একশ টাকার সাথে দুটো রাইডস যোগ করে কেন বাধ্যতামূলক দু’শ টাকা নেওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন পার্ক বন্ধ ছিল কিন্তু কর্মচারীদের বেতন ঠিকই দিতে হয়েছে। তাই এন্টি ফি এর সাথে দুটো রাইডস সংযুক্ত করা হয়েছে।’
করোনা পরিস্থিতির এই সময়ে এখানে ঘুরতে আসা বিনোদন প্রেমিদের কেন মাস্ক পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মাস্ক পড়ার জন্য কিছুক্ষণ পর পর মাইকে ঘোষণা দিচ্ছি সেটা হতো শুনে থাকবেন।’ জবাবে মাইকে ঘোষণা নয় মাস্ক ছাড়া কেন গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে পাল্টা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আরে ভাই আমি না থাকলেই এ অবস্থা হয়। আমার এখানে সব আছে মানুষের জ্বর মাপার যন্ত্রও আছে কিন্তু আমি না থাকলেই এমনটাই করে। কতক্ষণ আর পাহাড়া দিয়ে রাখা যায় বলেন।’
ময়লা-আবর্জনা ও বয়লার মুরগির বিষ্ঠার দূর্গন্ধের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন এক পাশে নয় পার্কে দু’পাশেই প্রতিবেশিদের বয়লার মুরগির দুটো ফার্মের দূর্গন্ধে সত্যিই তিনি খুব সমস্যায় আছেন। তিনি এদুটো ফার্মে বিষয়ে পত্রিকায় লেখালেখির জন্য প্রতিবেদককে অনুরোধ জানান।
(বি:দ্র: প্রতিবেদনের সকল তথ্যের ভিডিও চিত্র ও ভয়েজ রেকর্ড জোনাকী টেলিভিশন কার্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। যা পরবর্তীতে ভিডিও প্রতিবেদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে।)
Leave a Reply