নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের সিনেমা অঙ্গনে জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার (১৪ জুন) বিকেল ৩টার দিকে উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে নাসির উদ্দিনের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসময় বেশকিছু বিদেশি মদ উদ্ধার ও তিন জন নারীকে আটক করা হয়েছে। তাকে মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে মামলার তদন্ত সংস্থা সাভার থানা পুলিশে হস্তান্তর করা হবে।
মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগ গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সোমবার (১৪ জুন) সকালে সাভার মডেল থানায় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিনসহ অজ্ঞাতনামা আরও চার জনকে আসামি মামলা করেন অভিনেত্রী পরী মনি।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘নাসির এ মামলার প্রধান আসামি। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার সঙ্গে আরও দুজনকে আমরা হেফাজতে নিয়েছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওই দুজনের এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।
এর আগে দুপুরে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদসহ ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাসিরের বাসায় প্রবেশ করে। এসময় নাসির তার বেডরুমে খাটের ওপর বসা ছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে কয়েক বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করেছে ডিবি। তবে সেগুলো অনুমোদিত কিনা তা যাচাই-বাছাই করছে পুলিশ।
অভিযানের বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, গুলশান বিভাগে একটি টিম অভিযানে এসেছে। আমরা জানি, পরীমণি একটি হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছেন। মামলার সব আসামিকে গ্রেফতার করা হবে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নাসিরের বাসায় আসছি, অভিযান চালাচ্ছি।
নাসির ইউ মাহমুদ ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্য। তিনি ৩৭ বছর ধরে ডেভেলপার ব্যবসায়ে আছেন। ১০ বছর ধরে মাহমুদ কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। কুঞ্জ ডেভেলপার্সের আগে তিনি মাহমুদ বিল্ডার্স অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের এমডি ছিলেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগ থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান সরকারের গণপূর্ত অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি), রাজউক, রেলওয়েসহ সরকারি-বেসরকারি নানা ঠিকাদারি কাজ করেন।
নাসির ইউ মাহমুদ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক নির্বাহী পরিষদের সদস্য। তিনি ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের উত্তরা ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি, লায়ন ক্লাবের ঢাকা জোনের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এছাড়াও তিনি জাতীয় পার্টির (জাপা) একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাপার ৯ম কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।
মামলার এজাহারে পরীমণি বলেন, গত ৮ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার বনানীর বাসা থেকে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি (৩০), অমি (৪০) ও বনিসহ (২০) দুটি গাড়িযোগে তারা উত্তরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথে অমি বেড়িবাঁধস্থ ঢাকা বোট ক্লাবে তার দুই মিনিটের কাজ আছে বলে জানায়। অমির কথামতো সবাই রাত আনুমানিক ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাই। কিন্তু বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি কোনও এক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলে। তখন ঢাকা বোট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা গেট খুলে দেয়। পরে আমার ছোটবোন বনি প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে বোট ক্লাবে প্রবেশ করে ও বারের কাছের টয়লেট ব্যবহার করি। টয়লেট হতে বের হতেই এক নম্বর বিবাদী নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমাদেরকে ডেকে বারের ভেতরে বসার অনুরোধ করেন এবং কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। আমরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে অমিসহ এক নম্বর আসামি মদ্যপানের জন্য জোর করেন। আমি মদ্যপান করতে না চাইলে এক নম্বর আসামি জোর করে আমার মুখে মদের বোতল প্রবেশ করিয়ে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এতে আমার সামনের দাঁতে ও ঠোঁটে আঘাত পাই।
এজাহারে তিনি আরও বলেন, এক নম্বর আসামি (নাসির উদ্দিন মাহমুদ) আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে এবং আমাকে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সে উত্তেজিত হয়ে টেবিলে থাকা গ্লাস ও মদের বোতল ভাঙচুর করে আমার গায়ে ছুঁড়ে মারে। তখন কস্টিউম ডিজাইনার জিমি নাসির মাহমুদকে বাধা দিতে গেলে তাকেও মারধর করে নীলাফোলা জখম করে।
পরীমণি বলেন, আমি প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ নম্বরে ফোন দিতে গেলে আমার ফোনটি টান মেরে ফেলে দেওয়া হয়। এসময় দুই নম্বর আসামিসহ অজ্ঞাতনামা চার জন এক নম্বর আসামিকে ঘটনা ঘটাতে সহযোগিতা করে। আমি অজ্ঞাতনামা আসামিদের দেখলে শনাক্ত করতে পারবো।
এজাহারে তিনি আরও বলেন, দুই নম্বর আসামি অমি পরিকল্পিতভাবে আমাকে বর্তমান বাসা থেকে ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যায়। সে অজ্ঞাতনামা চার জন আসামি ও নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে এবং জোরপূর্বক আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। আমি আমার সঙ্গীদের সহায়তায় ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পাই। রাত আনুমানিক তিনটার সময় আমি আমার গাড়িযোগে প্রায় অচেতন অবস্থায় অপর সঙ্গীদের সহায়তায় বাসায় ফিরে আসি।
এর আগে, রবিবার (১৩ জুন) রাতে এক ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচারের দাবি জানান পরীমণি। অভিযোগ করেন, তাকে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করেছিল চারদিন আগে, ঢাকা বোট ক্লাবে। এমন বিস্ফোরক অভিযোগের ঠিক দুই ঘণ্টার মাথায় নিজ বাসায় বসে সাংবাদিকদের কাছে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেন পরী।
তিনি অভিযোগ করেন, তার ওপর নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছেন নাসির ইউ মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি। ঘটনাটি ঢাকার বোট ক্লাবে ঘটে। অভিযুক্ত নাসির উত্তরা ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে ঢাকা বোট ক্লাবের এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি পদে আছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বুধবার রাতে উত্তরার বোট ক্লাবে ঘটনাটি ঘটে। নাসির উদ্দিন নামে একজন তাকে নেশাজাতীয় কিছু খাইয়ে এ ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলেন।’
Leave a Reply