নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রতিদিন বাড়ছে পদ্মা, যমুনা, ধরলাসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি। এতে দেশের অধিকাংশ এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফরিদপুরে পদ্মার পানি গত সাত দিন ধরে বাড়ছে। ফলে দেশের মধ্যাঞ্চলের এই জেলাসহ পদ্মার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এই নদ-নদীগুলোর অববাহিকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ।
পদ্মায় তীব্র স্রোত বইছে। হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে এখন পদ্মায় প্রতি ঘণ্টায় স্রোতের গতিবেগ ১১ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার। এ পয়েন্টে বর্তমানে মোট প্রবাহের পরিমাণ ১৯ লাখ ৯১ হাজার ৪৭০ কিউসেক। আর পানির উচ্চতা ১৪ দশমিক ১৩ মিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোফাজ্জল হোসেন জানান, হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে স্রোতের গতিবেগ ৩ দশমিক ২৬২৬ মিটার পরিমাপ করা হয়েছে। অর্থাৎ ঘণ্টায় ১১ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার বলে তিনি জানান। হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে পানির উচ্চতা কমেছে।
গতকাল সোমবার পানির উচ্চতা ছিল ১৪ দশমিক ১৩ মিটার। ২১ আগস্ট পানির উচ্চতা উঠেছিল ১৪ দশমিক ২০ মিটার। তবে এ বছর এখনো পানির উচ্চতা বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমা হচ্ছে ১৪ দশমিক ২০ মিটার। তিনি জানান, ১৯৯৮ সালে পানির উচ্চতা উঠেছিল ১৫ দশমিক ১৯ মিটার। পানির মোট প্রবাহের পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ ৮১ হাজার ১৯৯ কিউসেক।
ফরিদপুরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি হওয়ার ফলে জেলা সদরসহ কয়েকটি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছেন।
সোমবার ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ফরিদপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি তিন সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।
পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিগ্রির চর ও চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের চরাঞ্চলের মানুষ। একই সঙ্গে চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গবাদি পশুর খাদ্য সঙ্কট। নষ্ট হয়েছে বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজি ক্ষেত।
চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, বন্যায় আমাদের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। চুলায় আগুন জ্বালানোর মতো কোনো জায়গা নেই। শুকনো খাবার খেয়ে থাকতে হচ্ছে। সহায়তা করতেও এখনও কেউ আসেনি।
নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের কাইমুদ্দিন মতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা কবির শেখ বলেন, আমার বাড়ির আশপাশের সব তলিয়ে গেছে। আমার উঠানেও পানি। এইভাবে পানি বাড়তে থাকলে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর, চরমাধবদিয়া ও ঈমান গোপালপুর ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ডিক্রিরচর ইউনিয়নের দুটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুম রেজা জানান, পানিবন্দি মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য ও গবাদিপশুর খাদ্য মজুত আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাদুর্গতদের নিরাপদ স্থানে রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ফরিদপুর সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, আমার ১২টি গ্রাম বন্যাকবলিত। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা আছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পানিবন্দি মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হবে। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান জানান, তার ইউনিয়নের ১৪টি গ্রামের ১৩ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি। তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।
শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপত্সীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গোয়ালন্দ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ সেন্টিমিটার পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তা এখন বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
শরীয়তপুর সংবাদদাতা জানান, শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ আগস্ট থেকে পদ্মা নদীর পানি নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভাঙন রোধে জাজিরার ৩৭টি, নড়িয়ার ১২টি, ভেদরগঞ্জের ২২টি, গোসাইরহাটের ১৪টি ও সদর উপজেলার ১৫টি স্থানে প্রায় ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ও জিওটিউব ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি বৃদ্ধির ফলে নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি, শেহের আলী মাদবরকান্দি ও চেরাগ আলী ব্যাপারিকান্দি এলাকায় সিসি ব্লক নির্মাণের তিনটি ইয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করায় ধরলা অববাহিকায় প্রায় সহস্রাধিক বাড়িঘরে পানি উঠেছে এবং তলিয়ে গেছে ৩ হাজার ২০০ হেক্টর রোপা আমনখেত। চরাঞ্চলগুলোর নিচু এলাকার বিভিন্ন ফসল ও গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। চরাঞ্চলসহ নদী অববাহিকার মানুষজন যাতায়াতে পড়েছে চরম বিপাকে। কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উমর ফারুক জানান, গত দুই দিনে ধরলার পানি বাড়ায় ইউনিয়নের ছয় শতাধিক বাড়িঘরে পানি উঠেছে। এছাড়াও নিচু জমির রোপা আমনখেত তলিয়ে গেছে।
নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমলেও বেড়েছে ভাঙন। সোমবার (২৩ আগস্ট) বিকাল ৩টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে, সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এ নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে নিশ্চিত করেছেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক মো. নুরুল ইসলাম।
মানিকগঞ্জের শিবালয়ের আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। ভাঙনের কবলে পড়েছে রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। এছাড়া পদ্মাসহ ইছামতী, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর পানিও বাড়ছে। মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারি, বাঘুটিয়া, শিবালয় উপজেলার অন্বয়পুর, আরিচা, নেহালপুর, জাফরগঞ্জ, ঘিওর উপজেলার সিংজুরি, বড়টিয়া, সদর উপজেলার কুশেরচর, হরিরামপুর উপজেলার ধুলশুরা, কাঞ্চনপুর, সুতালড়ী, লেছড়াগঞ্জ, আজিমনগর ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিন বলেন, হরিরামপুরের ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬ হাজার জিও ব্যাগ দিয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার ব্যাগ ফেলা হয়েছে।
গত তিন দিন ধরে মুন্সীগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার মূলচর গ্রামে পদ্মা নদীর ভাঙন চলছে। এতে অনেকেই ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা ঘর-বাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিচ্ছেন। সোমবার (২৩ আগস্ট) বিকাল পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০টি টিনশেড বাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আরও বেশকিছু ঘর সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। গ্রামের বাসিন্দারা ঘরের অনেকেই ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। পদ্মার শাখা নদী কয়েকটি বাড়ির গা ঘেঁষে আছে। প্রতিবছর ভাঙনে এই এলাকার ভৌগোলিক সীমা দিন দিন ছোট হয়ে আসছে।
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে বিপাকে রয়েছে গো-খামারিরা। যমুনা নদীর পানি মেঘাই ঘাট পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তলিয়ে গেছে শাহজাদপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি ও সবুজ ঘাস।
ফলে দুই লক্ষাধিক গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গো-খামারিরা। কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশ, তেকানি, মুনসুরনগর ও খাসরাজবাড়ি ইউনিয়ন এবং চৌহালী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শুরু হওয়া ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ও বসতভিটা। বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, যমুনা নদীর পানি আরো দুই-এক দিন বাড়তে পারে। এ সময়ের মধ্যে বিপত্সীমা অতিক্রম করতে পারে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়িয়া ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে যমুনা নদীর তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। যমুনার তীব্র ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে চুকাই বাড়ী ও চিকাজানি দুটি ইউনিয়নের মানচিত্র।
উপজেলার চিকাজানী ইউনিয়নে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি ও হ্রাস পাওয়ায় ভাঙনে কয়েক বছরে চিকাজানী খোলাবাড়ীর হাট, খোলাবাড়ী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর মাগুরীহাট, দেলোয়ার হোসেন এবতেদায়ী মাদ্রাসা, মসজিদ কবরস্থানসহ আশপাশ এলাকার বাড়িঘর ও স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে খোবাড়ী ও মন্ডল বাজার ব্যস্ততম একমাত্র সড়ক।
চুকাইবাড়ী বড়খাল গুলুঘাট হয়ে পূর্ব চুনিয়াপাড়া পর্যন্ত দেওয়ানগঞ্জ রক্ষা বাঁধ নামে হরিণধরা একটি বাঁধ ছিল। বাঁধটি ভাঙনের পর থেকে বিনা বাধায় যমুনা নদী লোকালয়ে ঢুকছে। দুই বছর ধরে নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু খেকুরা বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর ভাঙন বাড়ছে।
Leave a Reply