মোঃ শফিকুল ইসলাম:
১৪ আগস্ট ১৯৭৫ইং ফারুক তার স্ত্রী ফরিদাকে চট্টগ্রামের আন্ধা হাফিজের মন্তব্য টেলিফোনে ঢাকায় জানিয়ে দিতে বললো। ফরিদা যখন হাফিজের বাড়িতে উপস্থিত হলো তখন হাফিজ একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে আবেগজড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো-‘‘ তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমাদের যা করার করে ফেলো। তবে অত্যন্ত গোপনে কাজটা করতে হবে।’’ ফরিদা সন্ধ্যার আগেই ফারুককে হাফিজের মন্তব্য টেলিফোনে জানিয়ে দিলো। ফারুক অপারেশনের সর্বসময় নের্তৃত্তে দিবে বলে আগেই ভেবে রেখেছিলো। সে ভোর ৪টা ৪০ মিনিটের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আগাত আনার জন্য তার বাহিনীকে প্রস্তুত করে নিলো। পরবর্তী আধাঘন্টার মধ্যেই তার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে যাত্র শুরু করলো। বাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশকে কালো উর্দি পরিয়ে নিলো। যেটা পরবর্তীতে বাংলাদেশে এক ভয়ঙ্কর পোষাক নামে পরিচিতি পায়। সেদিন ছিলো শুক্রবার, ফজরের আযানের ধ্বনি যেন ফারুকের কানে মধু বর্ষণ করছিলো। মনে মনে ভাবতেছিলো হয় আজ সে নব জীবনের সূচনা করবে নয়ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পরবে। পরক্ষণেই তার ঘাতক বাহিনীকে সামনে বাড়ার নির্দেশ দিলো। শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর যাত্রা। ফারুক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৫টা ১৫ মিনিট হয়ে গেছে।
ধানমন্ডির ৩২নম্বর বাড়ির চারদিকের অবস্থা তখন গোলযোগপূর্ণ। ফারুকের পরামর্শে মেজর মহিউদ্দিন, নূর আর হুদার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রধান ঘাতক দলটি শেখ মুজিবের বাড়িতে পৌঁছে গেছে। তাদের সঙ্গে ৫ ট্রাক ভর্তি ১২০ জন সৈন্য আর একটি হাউইটাজার ছিল। মীরপুর রোডে লেকের হাউইটজারটি শেখ মুজিড়বের বাড়ির মুখোমুখি বসানো হলো। আরো কিছু সৈন্য এসে বাড়িটির চারদিক ঘিরে ফেলে। তারপরই মেজরবৃন্দ আর তাদের লোকেরা ভেতরে ঢুকে পড়ে।
বাড়ির বাইরে পাহারারত সশস্ত্র পুলিশ ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য দেখে ভয় পেয়ে যায় এবং কোন প্রকার জামেলা ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। গেটে পাহারারত ল্যান্সার প্রহরীরা ষড়যন্ত্রের সঙ্গেঁ জড়িত ছিলনা। কিন্তু যখন তারা তাদেরই সহকর্মী আর তাদেরই কিছু অফিসারকে দেখতে পেল, তখন তারা ঐ কালো উর্দি পরিহিত লোকদেরকে ভেতরে আসার সুবিধে করে গেট ছেড়ে দিলো। ঐ সময় শেখ মুুজিবের ব্যক্তিগত প্রহরীরা বারান্দায় ঘুমন্ত ছিল। আনাগোনার শব্দ শুনে ওরা জেগে উঠে। গেট দিয়ে অচেনা লোকদেরকে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে দেখে, তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি চালায়। আর্টিলারীর শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গেঁ সঙ্গেঁই সে মারা যায়। ল্যান্সার বাহিনীর আর একজন সৈন্য গুরুতর ভাবে আহত হয়। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বাড়ির ভেতর থেকে প্রচন্ড প্রতিরোধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে শত্রæর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেখ মুজিবের দেহরক্ষীদের খতম করে দিয়ে তারা বাড়ীর ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই তারা নীচতলার প্রতিটি রুম পালাক্রমে তল্লাসী করে দেখে। শেখ মুজিব নিজেও খুব তাড়াতাড়ি কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্ঠা চালান। প্রথমেই তিনি টেলিফোন করেন রক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে। সেদিন রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নুরজামান আর কর্ণেল সাহিব উদ্দিন দেশে ছিলোনা। উপায় না পেয়ে তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করে অবিলম্বে সাহায্য পাঠাবার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ফোনটি করেন সামরিক গোয়েন্দা বিবাগের ডাইরেক্টর কর্নেল জামিলকে। জামিল একটুও দেরী করলোনা। পোশাক পারিধানের সময় না পেয়ে তার পায়জামার উপরে ড্রেসিং গাউনটি চড়িয়ে দিয়ে লাল ভোক্সাওয়াগণ গাড়িতে করে সে প্রেসিন্ডেটের সাহায্যে ছুটে চললো। প্রচন্ড বেগে গাড়ি চালিয়ে এসে পৌঁছালো প্রেসিন্ডেন্টের বাড়ির দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি তখন কারবালায় পরিনত হয়ে গেছে। জামিল তার গাড়িটি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ব্যর্থ হলো। গেইটের বাইরেই তাকে থামিয়ে দিলো সৈন্যরা। অত্যন্ত কড়া ভাষায় বাক্য বিনিময়ের মধ্য দিয়েই জামিল তার গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। গাড়ি ফেলে সৈন্যদের পাস কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইলেই সৈন্যরা গুলি চালিয়ে দেয় জামিলের মাথায় ও বুকে। টলতে টলতে প্রেসিডেন্টের বাড়ির গেটের গোড়ায় মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ে জামিল। জীবনের বিনিময়েও সে বঙ্গবন্ধুর সাহায্যে আসতে পারলো না।
শেখ মুজিবুর রহমান এর ছেলে, শেখ কামাল আর শেখ জামাল সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে শত্রæকে পতিহত করার চেষ্টা করে। কামাল দু’জন সৈন্যকে আহত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। পরক্ষণেই সিড়ির গোড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এরই মধ্যে বাড়ির সর্বত্র ওরা ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর মহিউদ্দিন, হুদা আর নূর বাড়ির প্রতিটি কামরা বঙ্গবন্ধুর তন্ন তন্ন করে খোঁজে । প্রথমে অপ্রত্যাশিতভাবে মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে পায়। সে দু’তলায় উঠতে সিড়ির গোড়ায় পা ফেলতেই শেখ মুজিবকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ২০ ফুট। শেখ সাহেবের পরনে ছিলো তখন একটি ধুসর চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী। ডান হাতে ছিলো তাঁর ধুমপানের পাইপটি।
বঙ্গবন্ধকে হত্যা করার দৃঢ় মনোবল নিয়ে মহিউদ্দিন এ অভিযানে বেরহয়েছিলো। কিন্তু এখন সামনা-সামনি দাড়িঁয়ে পুরোপুরিভাবে মনোবল হাড়িয়ে ফেলে। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে তাঁকে বলছিল, ‘‘স্যার আপনি আসুন।’’
‘‘তোমরা কি চাও? তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কি মনে করো, তা করতে পারবা?” মুজিব অত্যন্ত কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করলো।
তিনি কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর চেষ্ঠা করছিলেন কারণ বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করে রেখেছিলেন। ইতিমধ্যে নিশ্চিয়ই লোকজন তাঁর সাহায্যে ছুটে আসছে। সেই সময়ে তিনি অত্যান্ত সাহসের পরিচয় দিচ্ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিলো অত্যান্ত প্রবল। মহিউদ্দিন তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারে নতজানু হয়ে পড়েছিল। মহিউদ্দিন আবারও ঐ একই কথা বলে চললো, ‘‘স্যার, আপনি আসুন।’’ আর অন্যদিকে শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকিয়ে যাচ্ছিলেন। সে মূহুর্তে নূর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে উপস্থিত হয়। সে বুঝে ফেলে ব্যপারটা, মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবোল তাবুল বকতে বকতে তার স্টেনগান থেকে ‘ব্রাশ ফায়ার’ করে। শেখ মুজিব কিছু বলার আর সুযোগ পেলনা। যেন স্তবদ্ধ হয়ে গেলো সারা বাংলাদেশ। স্টেনগানের গুলি তাঁর বুকের ডান দিকে একটা বিরাট ছিদ্রকরে বেরিয়ে গেলো। এ যেন বাংলাদেশের বানচিত্রকে ছিন্ন করে ফেলা হলো। গুলির আঘাতে তাঁর দেহ কিছুটা পিছিয়ে গেলো। তারপর নিস্তেজ হয়ে তাঁর দেহ মুখ-থুবড়ে সিড়িঁ দিয়ে কিছুধুর গড়িয়ে গিয়ে থেমে রইলো। তাঁর ধুমপানের প্রিয় পাইপটি তখনও তিনি শক্তভাবে ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন।
সময় তখন সকাল ৫টা ৪০ মিনিট। বাঙ্গালী জাতির সঙ্গেঁ শেখ মুজিবের প্রচন্ড ভালবাসার চিরতরে অবসান ঘটলো।গুলির শব্দ শুনে বেগম মুজিব তার স্বামীর অনুসরণ কতে চাইলে তাকেও বেডরুমের দরজার সামনেই ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হলো। তারপর হত্যা যঞ্জ চলতে লাগলো। অফিসার আর সৈন্যরা গুলি করে দরজার বোল্ট উড়িয়ে দিয়ে একেরপর এক রুমের দরজা খুলে ফেললো। তারপর ব্রাশ ফায়ার করে করে রুমগুলোকে ঝাঝড়া করে দেয়া হলো যেন একটা প্রাণিও এর ভেতরে বেঁচে থাকতে না পারে। শেখ মুজিবের দ্বিতীয় ছেলে শেখ জামাল সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে সেনাবাহীনিতে কাজ করছিলো। অবস্থা দেখে বাড়ীর বাকি সদস্যদের বাঁচানোর জন্যে সে তাদেরকে মেইন বেড রুমে এনে জমায়েত করে। এবার এলো তার মরার পালা। একজন অফিসার অত্যন্ত কাছ থেকে তাকে গুলি করলো, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে। শেখ জামাল মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে। নয় বছর পরও যেই দেয়ালের বিপরীতদিকে থেকে তাকে গুলি করা হয়েছিলো, সেই দেয়ালে তার রক্তের দাগ, হাডডি আর মাংশের কণা এমনকি বুলেটগুলি পর্যন্ত পরিস্কার প্রমাণ হিসেবে রয়ে গিয়েছিলো।
মুজিবের দুই তরুনী পুত্রবধু, কামাল আর জামালের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, রাসেলের গলা জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। রাসেল শেখ মুজিবের ১০ বছর বয়স্ক সর্বকনিষ্ট ছেলে। দুই পুত্রবধুকে জঘন্যভাবে টেনে আলাদা করে অত্যন্ত্য কাছে থেকে গুলি করে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। রাসেল তখন ঘরের আলনা ও অন্যান্য আসবাব পত্রের আড়ালে পালিয়ে জীবন বাঁচানোর স্বকরুণ ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশুটিকেও ঠিক একইভাবে সজোরে টেনে বের করে অত্যন্ত জঘন্যভাবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলা হলো। শেখ মুজিবের ছোট ভাই, শেখ নাসের, সে পাশের একটা বাথরুমে পালিয়ে ছিলো। সেখানে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নির্মম খুনের নীরব দর্শক এই বাড়িটির চারদিকে দাড়িয়ে থাকা দেয়াল।
হত্যাকারীরা এর পর পুরো বাড়িটা এক এক করে তল্লাশী চালায় এবং মূল্যবান সব কিছু লুটে নেয়। প্রতিটি আলমারী, প্রয়ার ও অন্যান্য আসবাব ভেঙ্গে ফেলা হয়। মূল্যবান জিনিসপত্র ছাড়া সব কিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হয়। বাড়ির প্রতিটি কামরাই যে এক একটা কসাইখানা আর সমস্তটা বাড়ি জুড়ে যেন মৃত্যুর গন্ধে ব্যকুল করে তুলেছিলো।
মৃত্যুর পরে শেখ মুজিবকে আর এক দফায় অবমাননা করা হলো। হত্যাকারীদের একজন জীবদ্দশায় শেখ মুজিবকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পায়নি। সুতরাং খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে সে তার পায়ের বুট মুজিব-দেহের নীচে দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে বুটের হেঁচকা টানে প্রাণহীন সর্বদেহটি উল্টিয়ে দিয়ে মনের সুখে বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখখানি দেখার তৃঞ্চা মেটায়। এর প্রায় চার ঘন্টা পর সরকারী তথ্য দফতর থেকে আগত একজন বিশেষ ফটোগ্রাফার ঐ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠায়।
Leave a Reply