ডেস্ক রির্পোট
দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ না কমা পর্যন্ত লকডাউন বলবৎ রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় এর পরিণাম ভয়াবহ হবে বলেও তারা জানিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের সেই পরামর্শ না মেনে শিথিল করা হয়েছে লকডাউন। খোলা হয়েছে কারখানা, গার্মেন্টস, দোকানপাট, মার্কেট। গণপরিবহনও চালু হবে খুব শিগগিরই। এরই মধ্যে দেশে নতুন করে করোনায় সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়েই চলছে, মৃতের সংখ্যাও। রবিবার ৮৮৭ জনের দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। গতকাল সোমবার এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩৪ জন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কঠোরভাবে লকডাউন না মানা এবং সংক্রমণ না কমিয়ে লকডাউন শিথিল করার যে সিদ্ধান্ত তার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগ যেখানে মে মাসকে ক্রিটিক্যাল বলছে; সেখানে অর্থনীতির চাকা সচল করতে গিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সঠিক হয়নি। এছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হলেও সেই কমিটির পরামর্শ গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। সমন্বয়হীনতা এখনো প্রবল বলে মনে করেন তারা। তাই তারা বলছেন, পরিস্থিতি যখন এই পর্যায়েই পৌঁছে গেছে তখন নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে লকডাউন কাজীর গরুর মতো। কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই। সরকার চেষ্টা করেও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও লকডাউন কার্যকর করতে পারেনি। ফলে সংক্রমণ দিনকে দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে গার্মেন্টস খুলে দিল। কারখানা খুলে দিল। হুড়মুড় করে মানুষ আসতে শুরু করল। এর প্রভাব কী হবে তা বলা মুশকিল। এই পরিস্থিতিতে নিজের সুরক্ষায় নিজেকেই সচেষ্ট হওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি বলেন, আর উপায় নেই। নাক-মুখ ঢাকা থাকে এমন মাস্ক ব্যবহার, চোখে চশমা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, আপনার সুস্থতা আপনার হাতে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা যেন স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলি।
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মনে করেন লকডাউন শিথিল না করে কঠোরভাবে তা পালনে বাধ্য করা উচিত। তিনি বলেন, গত দুই দিনেই আমরা দেখছি দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। গতকাল নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৪ জন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সচল হলে এই সংক্রমণ আরো বাড়বে। যা ভয়াবহ হবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ও করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান মনে করেন, দেশে লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর হয়নি। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, লকডাউন শিথিল করার পর বাধ ভেঙে মানুষের যে ঢল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি তা মোটেও আমাদের জন্য ভালো হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি হুমকি হবে। টেকনিক্যাল কমিটির পক্ষ থেকে বারবারই লকডাউন শিথিলের বিপক্ষে মত দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কাজ পরামর্শ দেয়া। তা আমরা দিয়েছি। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ তারা বিবেচনায় না নিলে আমাদের কিছু করার নেই। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করতে পারি না। সেই অধিকার আমাদের নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস মনে করেন লকডাউন শিথিল করার মধ্য দিয়ে আমরা দ্রুত সর্বনাশের দিকে যাচ্ছি। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, লকডাউন এখনই শিথিল করা সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। একজন জনস্বাস্থ্যবিদ হিসেবে আমি বলব কষ্ট করে হলেও অন্ততপক্ষে এই মাসটা পর্যন্ত লকডাউন কার্যকর রাখা উচিত ছিল। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনো সমন্বয়হীনতা বড় সমস্যা। কারণ স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সঙ্গতি আছে বলা হলেও বাস্তবে যে তা নেই তা এখন প্রতীয়মান। তাই লকডাউনই আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। কিন্তু তা আমরা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো আমি বলব শিথিল না করে কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকরা করা হোক।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে সামর্থ্যরে ঘাটতি ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন সরকার দলীয় নেতারাও। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গতকাল এক ভিডিও বার্তায় বলেন, জীবন ও জীবিকার জন্য আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ যত বাড়ছে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতাও ততটাই প্রকাশ পাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রোগতত্ত্ববিদ ভোরের কাগজকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না মেনে সরকার অর্থনীতি সচল করতে লকডাউন শিথিল করেছে। লকডাউন শিথিল করে ‘সীমত আকারে’ তকমা দিয়ে সব কিছু খুলে দেয়ার যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা দেখে মনে হয় সরকার হার্ড ইমিউনিটির ওপর ভরসা করতে চলেছে। কিন্তু এটা কি আমাদের দেশে সম্ভব? সামনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, যখন একটি এলাকার বেশিরভাগ মানুষকে কোনো একটি সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক দেয়া হয় তখন ওই এলাকায় ওই রোগটির ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ ওই এলাকায় আর সংক্রমিত হওয়ার মতো মানুষ কম থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি এলাকায় যদি হাম দেখা দেয়, আর বেশিরভাগ মানুষের যদি টিকা দেয়া থাকে তাহলে ওই রোগটি আর অন্য কারো মধ্যে ছড়াতে পারে না। কিন্তু করোনা ভাইরাসের এখনো কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তাহলে এটি মোকাবিলায় হার্ড ইমিউনিটি কীভাবে কাজ করবে? এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, যারা একবার ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। এভাবে বেশি বেশি মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকলে এক সময় অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যার কারণে মানুষের মধ্যে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি হয় এবং রোগটির সংক্রমণ থেমে যায়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস জানান, করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে হলে ৬০ থেকে ৯০ ভাগের বেশি মানুষ এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর আগে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ হার্ড ইমিউনিটির কথা চিন্তা করলেও পরবর্তী সময় সেই ভাবনা থেকে তাদেরও সরে আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, একসঙ্গে বেশি করোনা রোগী হয়ে গেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। তাই সরকার এমন একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি।
সূত্র ভোরের কাগজ অনলাইন
Leave a Reply