নিজস্ব প্রতিবেদক
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদী জেলায় এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তার অসম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে এ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ঢাকা থেকে অসংখ্য বাঙালি ইপিআর-আনসার-পুলিশ নরসিংদী চলে আসেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এন এম নূরুজ্জামান নরসিংদীতে তাদের একাংশকে সংগঠিত করে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করেন। এসব যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ১০ টি সাব-সেক্টর নিয়ে গঠিত ৩নং সেক্টরের ‘সেক্টর কমান্ডার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
৭১’র ৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী নরসিংদীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য প্রবেশের চেষ্টা করলে ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বাগবাড়ী কড়ইতলা নামক স্থানে মতিউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। প্রথমবারের মতো গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান। দুপুরের আগেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে ই.পি.আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাহিনী পেছনে সরে পালবাড়ীতে ক্যাম্প স্থানান্তর করে।
অপরদিকে বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীও রাতের অন্ধকারে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে। পরদিন ১০ এপ্রিল দুপুরের দিকে পাকবাহিনী মর্টার, রকেট সেল, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৫/১৬টি ট্রাক বহর নিয়ে মাধবদী বাবুরহাট পেরিয়ে পাঁচদোনা মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছালে পাল বাড়িতে অবস্থানরত এ. এন. এম নূরুজ্জামান নেতৃত্বে ইপিআর-আনসার-পুলিশ বাহিনীর সম্বনয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সাহসী দল তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গতিরোধ করে।
বিকাল পর্যন্ত মরণপণ যুদ্ধ করেও পাকিস্তানিবাহিনী সামনে এগুতো ব্যর্থ হয়ে বাবুরহাটের দিকে পিছু হটে। পরে ঢাকা থেকে আরও সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করলে পাকিস্তানি বাহিনী ফের নরসিংদী শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
সীমিত শক্তি নিয়ে রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর ই.পি.আর বাহিনীর গোলাগুলি শেষ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে মুক্তি বাহিনীকে অবস্থান ত্যাগ করতে হয়। এ সুযোগে নরসিংদী দখল করে নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ছুটিতে আসা নৌ সৈনিক নেহাব গ্রামের সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়। অপরদিকে মুক্তি বাহিনীর মাত্র দুই জন সৈন্য জখম হন। ই.পি.আরসহ মাত্র ১২ জন যোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলে শোনা যায়। তাদের সঙ্গে ছিল মাত্র ১টি মর্টার, ১/২টি মেশিনগান, কিছু রাইফেল ও গুলি।
এ যুদ্ধের খবর আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। ইতোপূর্বে ৩ এপ্রিল আকাশ বাণীতে প্রচার করা হয় যে, নরসিংদী থেকে প্রায় ৪ হাজার বাঙালি সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হয়েছেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী ৪ ও ৫ এপ্রিল বিমান থেকে প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী নরসিংদী শহরে বোমা বর্ষণ করে। এতে শহরের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই বিমান হামলায় নরসিংদী শহরের ৪/৫ জন সাধারণ মানুষও মারা যায়।
বোমা বর্ষণ ও নরসিংদী দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ফলে বিক্ষুদ্ধ জনতা আক্রোশে ফুঁসতে থাকে। নরসিংদীর নেতারা ই.পি.আর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈন্য এবং যুবক শ্রেণি দ্রুত নরসিংদী শহর ছেড়ে চলে যায়। তাদের সাথে সাথে এ. এন. এম নূরুজ্জামানও নরসিংদী ছেড়ে ভারতে চলে যান।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে ওঠার পর ৩ নম্বর সেক্টরের সহকারী সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান এ এন এম নূরুজ্জামান। সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম, পরে সেনাপ্রধান ও মেজর জেনারেল) আগস্ট মাসে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি ব্রিগেড গঠনের দায়িত্ব পান। তখন এ এন এম নূরুজ্জামানকে ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেন। ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর জেলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জ জেলার অংশবিশেষ এলাকা।
এ এন এম নূরুজ্জামানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন পরিচালনা করেন। তার সার্বিক নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে আখাউড়ার যুদ্ধ অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের মধ্যে রেল যোগাযোগের জন্য আখাউড়া রেলজংশন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আখাউড়া থেকে আগরতলা সড়কপথে সংযুক্ত। আখাউড়ার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তি ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে সেখানে আক্রমণ করে। কয়েক দিন ধরে সেখানে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৩ নম্বর সেক্টরের এক দল মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের একদল (১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) মুক্তিযোদ্ধা আখাউড়ার উত্তর দিকে ব্লকিং পজিশন তৈরি করেন। এর ফলে সীমান্তসংলগ্ন সড়ক ও রেলপথ পাকিস্তানিদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। এস ফোর্সের আরেক দল (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) মুক্তিযোদ্ধা একই দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৩ নম্বর সেক্টরের এক দল মুক্তিযোদ্ধা আগরতলা এয়ারফিল্ডের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালান। ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত আখাউড়ায় পাকবাহিনীর সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। ৫ ডিসেম্বর দুপুরে আখাউড়া মুক্ত হয়। এ.এন.এম. নূরুজ্জামান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়াভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ৩ নম্বর সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ.এন.এম. নূরুজ্জামান ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানাধীন সায়দাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আবু আহাম্মদ এবং মায়ের নাম লুৎফুননেছা। বাবার চাকুরী সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার শৈশব কেটেছে নূরুজ্জামানের। স্কুল জীবন কেটেছে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, কুমিল্লা ইউসুফ স্কুল, শেরপুর ভিক্টোরিয়া একাডেমি ও সুনামগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। সুনামগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং সিলেট এম.সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ছাত্র জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস.এম এ্যাথলেটিক সেক্রেটারী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক পাস করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে ‘গ্রাজুয়েট কোর্স’ এ যোগ দেন। ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কশিমন প্রাপ্তির পর তিনি যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী হিসেবে ১৯৬৮ সালেই তাকে বন্দী অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পান তিনি। কিন্তু তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
১৯৭১ সালে তিনি ব্যবসা করতেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলেন। ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নূরুজ্জামানকে পুনরায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে তাকে নবগঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে সরকার এ বাহিনী বিলুপ্ত করে। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর তার চাকুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকুরীকালীন তিনি অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, সেনেগাল, কানাডা ও সুইডেনে কর্মরত ছিলেন। সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৯৯৩ সালের ১৬ মার্চ স্টকহোমে তিনি মৃত্যূবরণ করেন। তাকে ঢাকার সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বীরউত্তম এ.এন.এম.নূরুজ্জামান সড়ক তার নামে ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেছে।
Leave a Reply